হতাশা-নিরাশা-ব্যর্থতার জেরেই গণপ্রহার, ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞদের
এই সময় | ০৪ জুলাই ২০২৪
গণপ্রহারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি মারাত্মক। নতুন কেন্দ্রীয় আইন ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ও দণ্ড সংহিতায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমনকী মৃত্যুদণ্ডেরও সংস্থান রয়েছে। কিন্তু তাতেও মারমুখী জনতার যেন ভ্রুক্ষেপ নেই! একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটেই চলেছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। ঝরছে একের পর এক তরতাজা প্রাণও। করোনা পরবর্তী বাংলায় যেন নতুন সংক্রমণের নাম গণধোলাই।কেন এমনটা হচ্ছে, তার কোনও সুস্পষ্ট কারণ এখনও জানা নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা এর নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এবং সকলেই প্রায় একমত যে, মারমুখী আগ্রাসনের ছোঁয়াচে রোগটা ক্রমেই জাঁকিয়ে বসছে জনমানসে। গত মাসের গোড়ায় প্রথমে চন্দননগর, তার পর বারাসতে দু'টি ঘটনায় চার জন গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন। একজন মারাও যান।
এরপর একে একে অশোকনগর, ঝাড়গ্রাম, বিশরপাড়া, রাজারহাট, বউবাজার, চণ্ডীতলা, পাণ্ডুয়া, এমনকী মঙ্গলবার শিয়ালদহেও ঘটে গিয়েছে একই ঘটনা। মারমুখী জনতা গণধোলাই-সংক্রমণের কবলে পড়ে এই কাণ্ড ঘটাচ্ছেন বলে মনে করছেন মনোরোগ কিংবা সমাজতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা।
তাঁরা বলছেন, একটি বা দু'টি ঘটনা ঘটলে, মারমুখী জনতার আবেগে, আচরণে তা সংক্রমিত হয়ে পড়ে দ্রুত। ফলে ঘটতে থাকে একের পর এক অনভিপ্রেত ঘটনা, যা একপ্রকার গণ-হিস্টিরিয়ার সঙ্গেই তুলনীয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বলেন, 'একা কিছু করতে গেলে ঝুঁকি সংক্রান্ত নানা হিসেব-নিকেষের কথা ঘোরে মাথায়। কিন্তু ভিড়ের কোনও নিজস্ব মুখ হয় না। ওখানে সবাই রাজা। তাই হতাশা আর আক্রোশের মিলিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। তাই গণপিটুনি এক জায়গায় হলে সেটা চেনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।'
জয়রঞ্জন মনে করেন, একটা জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটলে অনেকের মনে হয়, তার একটা সামাজিক স্বীকৃতি রয়েছে। তাই ন্যূনতম ইন্ধন থাকলে সেই আচরণই অনুকরণ করে অন্যরাও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক সৈকত বৈদ্য অবশ্য লাগাতার গণপিটুনির ঘটনাকে গণ-হিস্টিরিয়া মানতে নারাজ।
তাঁর বক্তব্য, 'এটা হলো বিহেভিয়োরাল অ্যান্ড ইমোশনাল কন্টাজিয়ন। অর্থাৎ আবেগ ও আচরণের ছোঁয়াচে বহিঃপ্রকাশ। যা আদতে একজনের মারমুখী প্রবণতার অন্যের মধ্যে সংক্রমণ। এর সঙ্গে মব বা ক্রাউড সাইকোলজির সম্পর্ক অতি নিবিড়। মবের বাইরে থেকে এসেও তখন গণপিটুনির ঘটনায় নিজে থেকে এসে সামিল হয়ে যায় লোকে। একে বলে কালেক্টিভ বিহেভিয়ার।'
সৈকতের ব্যাখ্যা, গণপিটুনির মানসিকতা ছোঁয়াচে বলেই একজন মানুষ তার মনের মধ্যে জমে থাকা দীর্ঘমেয়াদী নিরাশা, হতাশা, অপ্রাপ্তির বেদনা, ব্যর্থতার যাতনা- সবই এই আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে চরিতার্থ করে। যা এতদিন সামাজিক অনুশাসন ও লোকলজ্জার ভয়ে করতে না পেরে সে গুমরে মরছিল হয়তো।
সৈকতের কথায়, 'সে জানে, যদি সে এই মারমুখী জনসমুদ্রে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে মনের জ্বালা মেটায়, তা হলে জনতার ভিড়ে কেউ তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারবে না। ফলে থাকবে না ধরা পড়ার ভয়ও।' কিন্তু সকলেই কি এই মবের মধ্যে সামিল হয়? মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কখনোই নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা সামিল হয়, যাদের মনের গহনে লুকিয়ে থাকে অ্যান্টিসোশ্যাল বা ডিজ়সোশ্যাল ডিসফাংশনাল পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডারের বীজ।
সাধারণত এরা একটুতেই রেগে যান, হারিয়ে ফেলে ভালোমন্দের ফারাক করার ক্ষমতা। তারাই বেশি শরিক হন গণপিটুনির। জয়রঞ্জন আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন আরও একটি সামাজিক বিষয়। তাঁর কথায়, 'যখন আইন ও প্রশাসনের উপর আস্থা কমতে থাকে মানুষের, তখন নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ে মানুষের মধ্যে।'
একমত সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ও। তবে তাঁর সংযোজন, 'মানুষের আসল রাগ কিন্তু চোর সন্দেহে ধরা পড়া লোকের উপর নয়। আসল রাগ হলো, নেতা-মন্ত্রীর মতো সমাজের উপরতলার মানুষের উপর। কিন্তু লোকে বোঝে, ওই সব ওপরতলার মানুষ অত্যন্ত সুরক্ষিত, তাঁদের কিছুই করা যাবে না। সেই চাপা রাগটারই পথ ভুলে বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাচ্ছে এই গণপ্রহারের ক্ষেত্রে।'