জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা আছেন যথারীতি। তাঁদের সঙ্গে আবার ধুতি পরে পদ্মাসনে শ্রীরঘুনাথ। তাঁর উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশি বলে দূর থেকে শ্রীরামচন্দ্র বা রঘুনাথকে আগে দেখতে পান ভক্তরা। নদিয়ার শান্তিপুরে বড় গোস্বামী বাড়ির প্রাচীন জগন্নাথদেবের রথ তাই রঘুনাথের রথ বলে বেশি পরিচিত। বড় গোস্বামী বাড়ি ছাড়াও শান্তিপুরের হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি, সাহা বাড়ি, এবং সূত্রাগড়ের একটি রথেও রামচন্দ্রের বিগ্রহ দেখা যায়। তবে বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যদের দাবি, তাঁদের রথে রামচন্দ্র বিগ্রহ অন্যদের থেকে আগে প্রতিষ্ঠিত।পুরীর রথে লক্ষ মানুষের সামনে শ্রীচৈতন্যদেবকে যিনি অবতার বলে ঘোষণা করেছিলেন সেই বৈষ্ণবগুরু অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর বড় ছেলের বংশ 'বড় গোস্বামী' বাড়ি বলে পরিচিত। এই বংশের বর্তমান সদস্য ষাটোর্ধ্ব সত্যনারায়ণ গোস্বামী বলেন, 'আমাদের পরিবারের রথ প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো। তবে একদম শুরু থেকে রথের দেবতা হিসেবে শ্রীরঘুনাথের বিগ্রহটি কিন্তু ছিল না। বংশ পরম্পরায় শুনেছি, স্যর অতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (আইসিএস) পরিবার এই বিগ্রহটি কোনও একবার রথের আগে আমাদের পরিবারকে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমাদের বাড়ির রথের অন্যতম দেবতা দারু নির্মিত এই রামচন্দ্র বিগ্রহ। আমাদের বাড়ির মন্দিরে অন্য দেবদেবীর পাশে এই বিগ্রহও বছরভর নিত্যপুজো পান।
তিনি বলেন, 'একদম প্রথম দিকে আমাদের রথটি লোহার ছিল। মাঝখানে সেটি দারু নির্মিত হয়ে পুজো পাচ্ছিল। সংস্কার করতে গিয়ে বছর চল্লিশ আগে ফের লোহার রথ বানানো হয়েছে। উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। তিনটি ধাপে মোট ৯টি চূড়া আছে। জগন্নাথ, সুভদ্রার পাশে থাকা বলরাম অনেকটা লাঙল নেওয়ার ঢঙে দাঁড়ানো। তবে এই তিনটি বিগ্রহ আকার ও আকৃতিতে শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহের তুলনায় অনেক ছোট।
চেন-পুলি দিয়ে দিয়ে যখন রথের উপরের তলায় শ্রীরামচন্দ্রকে তোলা হয়, সেই দৃশ্য দেখতে বহু ভক্ত ভিড় করেন। আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে একদম মাতালগড় পর্যন্ত রথ যেত। বর্তমানে রথ টানা হয় আগমেশ্বরী পাড়া পর্যন্ত। সোজা ও উল্টো রথে এই পথের দু'ধারে মেলা বসে।
বাংলা রামায়ণের মহাকবি কৃত্তিবাসের জন্মভিটে শান্তিপুরের কাছে বলেই কি রথের দেবতা হিসেবে শ্রীরামচন্দ্র গুরুত্ব পেয়েছেন? সত্যনারায়ণ মানতে চাননি এ যুক্তি। তিনি বলেন, 'সেরকম হলে বংশ পরস্পরায় এ কথা আগে নিশ্চয় কানে আসত।' নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, 'শান্তিপুরের কাছেই ফুলিয়া বয়রায় মহাকবি কৃত্তিবাসের জন্মভিটে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছেছিল। ফুলিয়া ঘরের কাছে বলে গোটা শান্তিপুরে রামচন্দ্রের একটা বাড়তি প্রভাব তো আছেই। সম্ভবত সেই কারণেই এই অঞ্চলে রথের অন্যতম দেবতা হিসেবে শ্রীরামচন্দ্রও পুজো পেয়ে আসছেন।'