দুই রথযাত্রার বয়স প্রায় আড়াইশো বছর। একটি মহিষাদল রাজবাড়ি। অন্যটি রামনগরের ডেমুরিয়া। প্রাচীন এই দুই রথযাত্রা বর্তমানে সর্বজনীন হলেও পরিবর্তন হয়নি ধর্মীয় আচারে। আজও দুই মেলায় ভিড় জমান কয়েক লক্ষ মানুষ।মহিষাদলের রথযাত্রায় রাজকীয় আভিজাত্য থাকলেও ডেমুরিয়ার রথের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বর্গি হানার ইতিহাস। বাংলার নবাব তখন আলিবর্দী খান। সেই সময়ে ডেমুরিয়ার মৈতনা এলাকা ছিল ঘনজঙ্গলে ঢাকা। এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে পুণ্যার্থীরা পুরী যেতেন জগন্নাথ দর্শনে। ভক্তদের পুরী যাতায়াতে গাইড-এর কাজ করতেন ডেমুরিয়া গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ মগ্নী নারায়ণ চৌধুরী।
এটাই ছিল তাঁর পেশা ও নেশা। একদিন কয়েকজনকে নিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে পুরী যাওয়ার সময়ে বালেশ্বরের কাছে একটি চটিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাতে স্বপ্নে তাঁকে জগন্নাথদেব দেখা দিয়ে বলেন, বাড়ি ফিরে গ্রামের মাজনা পুকুরে থাকা কাঠ তুলে মূর্তি তৈরি করে তাঁর পুজো করতে। সেই নির্দেশ মেনে পুকুর থেকে পাওয়া কাঠে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করে পুজো শুরু করেন মগ্নী নারায়ণ। ক্রমে মন্দিরে ভক্তদের ভিড় বাড়তে শুরু করে।
১৭৪২ সালে বর্গীরা এই পথে বাংলায় হানা দেয়। মৈতনা এলাকায় ঘাঁটি গাড়ে তারা। বর্গিদের ভয়ে মগ্নী নারায়ণ জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি প্রতিবেশী করুণাকরণ ত্রিপাঠীর বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। তবে প্রতিদিন ভোগ রান্না করে তাঁর বাড়িতে গিয়ে জগন্নাথদেবকে নিবেদন করে আসতেন তিনি। বর্গিদের ভয়ে প্রায় ১০ বছর জগন্নাথদেবকে লুকিয়ে রাখায় বন্ধ হয়ে যায় রথযাত্রার অনুষ্ঠান। পরে রথের মেলা চালু হলেও জগন্নাথের নব কলেবর অনুষ্ঠানে ছেদ পড়ে।
নতুন করে আর বিগ্রহ তৈরি না হওয়ায় ২৫০ বছরের প্রাচীন কাঠের মূর্তিতে আজও এখানে পূজিত হন জগন্নাথ। ডেমুরিয়া মেলা কমিটির সদস্য ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ তমালতরু দাস মহাপাত্র বলেন, 'শুধু মৈতনার রাস্তা দিয়ে বাংলা থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে পুরী যেতেন তাই নয়, দক্ষিণ ভারত থেকে বহু সাধুসন্ন্যাসী এই পথ দিয়ে কাঁথির রসুলপুর হয়ে নৌকায় চেপে সাগরে যেতেন। হাতি-ঘোড়া নিয়ে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে থাকতেন শিষ্যরা। রাস্তায় কোনও এক জায়গায় তাঁবু ফেলে দুপুরের আহার বা রাত্রিবাস করতেন। সেই সময়ে মহাবীর মঠ গড়ে ওঠে এখানে। পরবর্তীতে রামানুজ সম্প্রদায়ের সাধুরা এই মঠে থাকা শুরু করেন।'
অন্যদিকে, ১৭৭৬ সালে মহিষাদল রাজ পরিবারের রাজমাতা জানকী দেবী মহিষাদলে রথের সূচনা করেন। প্রথমে রথের চূড়ার সংখ্যা ছিল ১৭। কিন্তু রথ টানতে গিয়ে সমস্যা হওয়ায় চূড়ার সংখ্যা কমিয়ে ১৩টি করা হয়। এই রথে মোট ৩৪টি চাকা। উচ্চতা ৪০ ফুট। তবে রথের চূড়ায় কলসি-ধ্বজা দিয়ে সাজানোর পর উচ্চতা হয় প্রায় ৫০ ফুট।
আজও নিয়ম মেনে রাজপরিবারে সদস্যরা রথের সূচনা করেন। মহিষাদল রাজ পরিবারের সদস্য হরপ্রসাদ গর্গ বলেন, 'পঞ্চায়েত সমিতি, ব্লক প্রশাসন, পুলিশের সহযোগিতায় পুরোনো ঐতিহ্য মেনে এ বারও রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।'