বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: রবিবার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির ছন্দপতন হয়েছে ঠিকই, স্বস্তি ফেরেনি। উলটে উদ্বেগ সপ্তমে। একদিকে নদীর জলস্তর কমতে বেড়েছে ভাঙনের বিপদ। জলদাপাড়ার তোর্সা এবং শিসামারা উপচে পড়েছে। কোথাও বনের রাস্তা ভেসেছে। অনেক নজর মিনারে খাবার ও জল নৌকায় পৌঁছে দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ু এবং ঘূর্ণাবর্তের যুগলবন্দিতে চলতি সপ্তাহে উত্তরের শিয়রে ঘোরতর দুর্যোগের বিপদ অপেক্ষায়। তাই উদ্বেগ কাটবে আপাতত তেমন লক্ষণ নেই।
ভয়ঙ্কর বিপর্যের মুখোমুখি হতে পারে উত্তরের পাহাড়-সমতলে পাঁচ জেলা। সোমবার এমনই আভাস মিলেছে ভারত ও ভুটানের আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে। জানা গিয়েছে, বুধবার থেকে দার্জিলিং পাহাড়, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে ২০০ মিলিমিটার থেকে তারও বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল। ‘লাল’ এবং ‘কমলা’ সতর্কতা জারি হয়েছে জেলাগুলোতে। তুমুল বৃষ্টিপাতের জন্য এখানে হতে পারে ব্যাপক হড়পা বান এবং ভূমিধসের বিপর্যয়। বিপদের সম্ভাবনা আরও তীব্র হয়েছে ভুটানের আবহাওয়া দপ্তর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর হাইড্রোলজি অ্যান্ড মেট্রোলজি’ থেকেও দক্ষিণ ভুটানে ২০০ মিলিমিটারের বেশি ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ এবং হড়পা বান ও ভূমিধসের সতর্কতা জারি করায়।
আবহাওয়া দপ্তরের কর্তারা জানিয়েছেন, দক্ষিণ ভুটানের জলে বিধ্বস্ত হতে পারে ডুয়ার্সের হাসিমারা, কালচিনি, বক্সা ও জলদাপাড়া জঙ্গল এলাকা, আলিপুরদুয়ার শহর এবং কোচবিহার জেলা। একই সময়ে উত্তর সিকিমেও অতিভারী বর্ষণের সম্ভাবনা থাকায় ফের বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে তিস্তা। সিকিমের পাশাপাশি বিপন্ন হতে পারে জলপাইগুড়ি ও কালিম্পং জেলা। ইতিমধ্যে নদীর জলস্তর নামতে ভাঙনের বিপদের মুখে কোচবিহার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তুফানগঞ্জ ২ নম্বর ব্লকের লাঙ্গল গ্রাম বেগারখাতায এলাকায়। একমাত্র রাস্তা রায়ডাক নদীর জলস্তরে ভেঙেছে। প্রায় দুই শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে ত্রাণ শিবিরে। লাগাতার ভাঙনের কবলে প্রস্থ তুফানগঞ্জের কৃষ্ণপুর, দিনহাটার গীতালদহ, ওকরাবাড়ির মতো এলাকা। পরিস্থিতি সামাল দিতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ১১টি এলাকায় কাজ শুরু করেছে সেচদপ্তর। কিন্তু সেখানেও বুধবার থেকে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায় সেই চিন্তায় ঘুম উড়েছে সেচ দপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের কর্তাদের।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরের সিকিম কেন্দ্রের অধিকর্তা গোপীনাথ রাহা বলেন, “উত্তরের পাহাড়-সমতলের পাঁচ জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে কমলা ও লাল সতর্কতা জারি হয়েছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বাড়বে।” আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, দার্জিলিং পাহাড়ে অতিভারী বর্ষণের ‘কমলা’ সতর্কতা জারি হয়েছে ১০ এবং ১২ জুলাই। মাঝে ১১ জুলাই রয়েছে অতিরিক্ত ভারী বর্ষণের ‘লাল’ সতর্কতা। জলপাইগুড়িতে ১০ জুলাই থেকে ১২ জুলাই রয়েছে অতিভারী বর্ষণের ‘কমলা’ সতর্কতা। আলিপুরদুয়ারে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেশি থাকতে পারে। এখানে ১০ এবং ১১ জুলাই অতিরিক্ত ভারী বর্ষণের ‘লাল’ সতর্কতা জারি হয়েছে। ১২ জুলাই থাকবে অতিভারী বর্ষণের ‘কমলা’ সতর্কতা। কোচবিহারে ১১ জুলাই ‘লাল’ এবং ১০-১২ জুলাই ‘কমলা’ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। শঙ্কা দেখা দিয়েছে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবারের মধ্যে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে দার্জিলিং ও কালিম্পং পাহাড়ে? ইতিমধ্যে দার্জিলিং পাহাড়ে ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়কের পাগলাঝোরা, ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের সেলফিডারা, মিরিক বাইপাস রোড, লাভা-লোলেগাও রোড, দার্জিলিং রেল স্টেশন হিলকার্ট রোড, রোহিণী রোড এবং মিরিক সৌরাণী ভূমিধসে বিধ্বস্ত হয়েছে। ধস নেমেছে সেভকেও।\
এখানে ভারী থেকে অতিরিক্ত ভারী বর্ষণ কিছুদিন থেকেই চলছে। ২ জুলাই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২৮৭ মিলিমিটার, ৩ জুলাই হয়েছে ১১৩ মিলিমিটার এবং ৭ জুলাই ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ২৯ জুন ১৯৭ মিলিমিটার এবং ৩০ জুন ২১৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
কার্যত আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কতা থেজে স্পষ্ট মঙ্গলবার ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে। এই সময় দার্জিলিং, কালিম্পং ও উত্তর দিনাজপুরে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। বুধবার বৃষ্টির তীব্রতা বাড়বে।দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে ভারী থেকে অতিরিক্ত ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এই সময় উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ জেলায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা প্রবল। এই সময় দার্জিলিং, কালিম্পং ও কোচবিহারে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে উত্তর সিকিমেও ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের সতর্কতা রয়েছে। সিকিম প্রশাসনের তরফে সেখানে নজরদারি বাড়িয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মঙ্গন জেলায় ‘কমলা’ সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া দপ্তর। পাকিয়ং, নামচি জেলায় অতিভারী বৃষ্টির সতর্কতা রয়েছে। পূর্বাভাস মতো উত্তর সিকিমে বৃষ্টি হলে তিস্তা মারমুখী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। সেটা হলে সিকিমের পাশাপাশি বিপদ বাড়বে কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলার। এখনও কালিম্পংয়ের তিস্তাবাজার রোডের উপর তিস্তার জল বইছে। নদীপারের কয়েকটি বাড়ি তলিয়ে যাওয়ার মুখে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংগামী ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়কের পাগলাঝোরার নতুন করে রাস্তা বসতে শুরু করেছে। ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের ২৭ মাইল থেকে গোটা রাস্তা কাদায় মুড়েছে। তিস্তা-দার্জিলিং রোড কোনওমতে খুলেছে। সিকিমের ডিকচু-সংকলন, সংকলন-টুং রোডে হাল্কা গাড়ি চলাচল করছে। যদিও মেয়ংনালা খোলায় ফের ধস নেমে রাস্তা অবরুদ্ধ হয়েছে। লেগসেপ-গেজিং রাস্তা বন্ধ আছে। এদিকে ভুটানের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর হাইড্রোলজি অ্যান্ড মেট্রোলজি’ দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, একদিকে মৌসুমি বায়ু সক্রিয়। তার দোসর হয়েছে সক্রিয় নিম্নচাপ অক্ষরেখা। দুইয়ের প্রভাবে ১১ জুলাই পর্যন্ত ভারতের ডুয়ার্স লাগোয়া দক্ষিণ ভুটানে তুমুল বর্ষণের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।