এই সময়: রাজ্যের বিএলআরও দপ্তরগুলিতে অসাধু চক্র ভাঙতে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি জমি জবরদখল, পুকুর-জলাশয় ভরাট, বেআইনিভাবে জমির চরিত্র বদল, মিউটেশনে দুর্নীতি সহ একাধিক অভিযোগ নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে সরব হয়েছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর অসন্তোষ প্রকাশের একমাস কাটতে না কাটতেই জেলাস্তরে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের ৪৫৬ জন আধিকারিককে একসঙ্গে বদলির নির্দেশ জারি করল নবান্ন।এর মধ্যে ৩৮৪ আধিকারিককে আগামী শুক্রবার, ১২ জুলাইয়ের মধ্যে বর্তমান কাজের জায়গা থেকে রিলিজ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি তাঁদের রিলিজ না করা হয়, তাহলে পরের কাজের দিন অর্থাৎ সোমবার থেকে তাঁরা অটোমেটিক্যালি রিলিজ হয়ে গিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। বাকি ৭২ জন রেভিনিউ অফিসারকে আগামী সোমবার, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে বর্তমান কাজের জায়গা থেকে রিলিজ করে দিতে বলা হয়েছে।
এই বদলির আদেশ পরিবর্তন বা বাতিল করা নিয়ে কারও ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী মহলের সুপারিশকে গ্রাহ্য করা হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর। রাজ্য প্রশাসনিক মহল এক দিনে এক সঙ্গে এতজনের এই বদলির নির্দেশকে এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত বলে মনে করছে। বদলির তালিকায় কোচবিহার থেকে কলকাতা সব জেলারই ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিকরা রয়েছেন। সরকারি সূত্রের খবর, নবান্নের এই নির্দেশে জেলাস্তরে একসঙ্গে ৪০ শতাংশের বেশি আধিকারিককে সরিয়ে দেওয়া হলো।
নবান্নের এক প্রশাসনিক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘এর সঙ্গে পদোন্নতি বা শাস্তি দেওয়ার কোনও যোগ নেই। এর আগে ৪৪ জনকে প্রোমোশন দেওয়া হয়েছিল। ২ জুলাই থেকে তাঁদের প্রশিক্ষণও শুরু হয়েছে। ফলে ওই অফিসারেরা এই বদলির তালিকাভুক্ত হননি। লোকসভা ভোটের জন্য আগে নির্দেশ জারি করা যায়নি। তাই এখন রুটিনমাফিক বদলি করা হচ্ছে।’
ভূমি দপ্তরের জেলাস্তরে বদলির তালিকায় স্পেশাল রেভিনিউ অফিসার পদমর্যাদার আধিকারিক রয়েছেন ১৭৯ জন। এর মধ্যে কলকাতার ঠিকা কন্ট্রোলারও(ঠিকা জমি নিয়ে যাঁর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত) রয়েছেন। তাঁকে পুরুলিয়ার ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অফিসার পদে বদলি করা হয়েছে। তালিকায় রয়েছে, বাঁকুড়া, দার্জিলিঙের ডেপুটি ভূমি রাজস্ব আধিকারিক ছাড়াও বিভিন্ন ব্লকের বিএলআরও, এসডিএলআরও, ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন আধিকারিকের নাম।
সরকারি জমি জবরদখল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কড়া বার্তার পরেই ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কর্তারা সক্রিয় হয়েছেন। জেলা আধিকারিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, নতুন করে কেউ যাতে সরকারি জমি জবরদখল করতে না পারে তা দেখতে হবে। পাশাপাশি যেখানে জবরদখল হয়েছে সেগুলি ধাপে ধাপে পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে দখল মুক্ত করতে হবে।
এব্যাপারে অগ্রাধিকারের তালিকা তৈরি করে কাজ শুরুর কথাও বলা হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জবরদখলের জন্য কোনও সরকারি প্রকল্পের কাজ যেন আটকে না থাকে। শুধুমাত্র যে জমি কোনও সরকারি কাজে লাগবে না, সেখানে উচ্ছেদের জন্য এখনই গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এছাড়া যে সব আধিকারিকের বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিংস (ডিপি) শুরু হয়েছে তাও দ্রুত শেষ করতে হবে।
রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বিএলআরও অফিসগুলিতে টাকার বিনিময়ে নানা ধরনের কাজ হয় বলে অভিযোগ। টাকা দিলেই জমির চরিত্র বদল, নাম পরিবর্তন, ভুয়ো কাগজ দাখিল করে মালিকানা বদলের মতো অপরাধে দপ্তরের কর্মীরা যুক্ত বলে নবান্নে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে।
কয়েকমাস আগে মুখ্যমন্ত্রী পুরুলিয়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে সেই জেলার বিএলআরও অফিসের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর বিভিন্ন জেলার বিএলআরওদের কাজ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। লোকসভা ভোটের পরে হাওড়ায় জমি দখল নিয়েও কড়া মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
কিছুদিন আগে নবান্ন সভাঘরে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী সিনিয়র আইএএস বিবেক কুমারকে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের দায়িত্ব দিয়ে বিএলআরওদের বদলি শুধু নয়, তাঁদের পরিবর্তে ডব্লিউবিসিএস সার্ভিসের মতো অন্য কোনও সার্ভিসের লোক নিয়োগ করার কথা ভাবতে বলেছিলেন। কারণ, জেলায় জেলায় বিএলআরও দপ্তরগুলিকে কেন্দ্র করে অসাধু চক্র চলছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরেও অভিযোগ এসেছিল।
ওই সব অভিযোগের ভিত্তিতে এক ঝাঁক বিএলআরও-র বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিংস(ডিপি) শুরু হয়েছে। সেই তদন্ত প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই একসঙ্গে এতজনকে বদলি করে ঘুঘুর বাসা ভাঙার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে নবান্ন।