যা এতদিন ছিল কাঁটা, তাকেই শোকেস করে আর্ন্তজাতিক দরবারে যাচ্ছে কলকাতা বিমানবন্দর। দ্বিতীয় বা সেকেন্ডারি রানওয়ের উত্তর মুখে থাকা একটি মসজিদকে রেখেই এখানে কীরকম মসৃণ ভাবে উড়ান পরিষেবা চালানো হচ্ছে, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট-এর নিরিখে কলকাতা বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে সেটাই এখন পজ়িটিভ পয়েন্ট।সোমবার তাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে ইন্টারন্যশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজ়েশন (আইকাও)-এর রিজিওনাল কনফারেন্সে সেই ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট-কে তুলে ধরতে চলেছেন কলকাতা বিমানবন্দরের কর্তারা। এয়ারপোর্ট অথরিটির দিল্লির সদর দপ্তরের একটি সূত্রের দাবি, কে কত সফল ভাবে বিমানবন্দরে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সামলাচ্ছে, তা-ই দেশের সমস্ত বিমানবন্দরের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
নিজেদের মতো করে সবাই রিপোর্টও জমা দিয়েছিল। সেই জমা পড়া রিপোর্টগুলির মধ্যে প্রথম হয়েছে কলকাতা। যে ভাবে বছরের পর বছর ধরে মসজিদ রেখে এখানে নির্বিঘ্নে উড়ান পরিষেবা চালানো হয়েছে, তা রীতিমতো প্রশংসার দাবি রাখে বলে জানিয়েছেন সেই সূত্র। ব্যাঙ্ককে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশের বিমানবন্দর থেকেও প্রতিনিধিরা আসবেন। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের নিরিখে প্রতিটি দেশের সফল বিমানবন্দর তুলে ধরবে তাদের কথা। ভারত থেকে থাকছে কলকাতা।
কলকাতার দ্বিতীয় রানওয়ে উত্তর দিকে যেখানে শেষ হয়েছে, তার প্রায় ৩০০ মিটার দূরে দীর্ঘদিন কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই মসজিদ। বিমানবন্দরের চৌহদ্দির বাইরে প্রধানত বাঁকড়া এলাকার স্থানীয় মানুষদের একাংশ নিয়মিত এই মসজিদে নমাজ পড়তে আসেন। শুক্রবার ভিড় হয় একটু বেশিই। ওই মসজিদ থাকার ফলে দ্বিতীয় রানওয়ে উত্তর দিকে আর বাড়ানো যায়নি।
অনেক আকুতি-মিনতি করেও হাই সিকিওরিটি জ়োনে থাকা ওই মসজিদ সরানো যায়নি। ফলে, তাকে রেখেই শুরু হয় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। কলকাতার প্রধান বা মেন রানওয়ের সমান্তরাল এই সেকেন্ডারি রানওয়ে। লম্বায় প্রধান রানওয়ে ৩৭০০ মিটার হলেও ওই মসজিদের জন্য সেকেন্ডারি রানওয়ে ৩২০০ মিটারের বেশি বাড়ানো যায়নি।
সেই মসজিদ সরিয়ে বিমানবন্দরের ভিতরে আরও পশ্চিমে নিয়ে আসার প্রস্তাবও একসময়ে দেওয়া হয়েছিল। যার জন্য আলাদা জায়গাও বেছে রেখেছে এয়ারপোর্ট অথরিটি। কিন্তু, মসজিদ কমিটি সেই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছে। এর পরে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে নামে কলকাতা বিমানবন্দর।
ডিপারচারের সময়ে প্রতিটি বিমান যাতে ট্যাক্সি করে একেবারে মেন রানওয়ের উত্তর প্রান্তে গিয়ে উঠতে পারে, তার জন্য একটি লম্বা ট্যাক্সি-বে বানানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কারণ, তার আগে বিমান মেন রানওয়ের প্রায় মাঝখানে গিয়ে উঠছিল। সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে রানওয়ের একেবারে উত্তর প্রান্তে পৌঁছোচ্ছিল। তারপরে মুখ ঘুরিয়ে তবে টেক-অফ এর জন্য দৌড় শুরু করছিল।
এতে বিমানের জ্বালানি যেমন বেশি পুড়ছিল, তেমনই রানওয়েতে তার সময়ও বেশি লাগছিল। সেটা এড়াতে প্রয়োজন ছিল সেকেন্ডারি রানওয়ের পশ্চিম প্রান্তে একটি ট্যাক্সি-বে। কিন্তু বাধ সেধেছিল সেই মসজিদ। কারণ, নতুন ট্যাক্সি-বে বানালে তাকে টপকেই যেতে হতো মসজিদে। ভূ-ভারতে এমনটা কেউ শোনেননি, সাধারণ মানুষ কোনও বিমানবন্দরের ভিতরের ট্যাক্সি-বে টপকে যাতায়াত করছেন। তার পারমিশনও দেওয়ার কথা নয় বিমান পরিবহণের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ)-এর।
তখন নতুন পরিকল্পনা ভাঁজে কলকাতা বিমানবন্দর। ঠিক হয়, রেলের লেভেল ক্রসিংয়ের মতো গেট বানানো হবে নতুন তৈরি ওই পাপা ট্যাক্সি-বের ধারে। বিমান যখন ট্যাক্সি করবে বা গড়িয়ে যাবে, তখন বন্ধ থাকবে সেই গেট। আর যে সময়ে বিমানের আনাগোনা কম হবে, তখন সেই ট্যাক্সি-বে পেরিয়ে মানুষ মসজিদে যাতায়াত করবেন। তবে পায়ে হেঁটে নয়। তার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে বাসেরও।
সেই পরিকল্পনায় সিলমোহর দেয় ডিজিসিএ। এখন সপ্তাহে সাতদিন মসজিদে নমাজ পড়তে মানুষ বাঁকড়ার গেট দিয়ে হাই সিকিওরিটি জ়োনে ঢোকেন। তাঁদের বসার জন্য ছোট একটি ঘর বানানো হয়েছে। থাকছে বাসও। সেখানে উপস্থিত থাকছেন বিমানবন্দরের অফিসার। তিনি যোগাযোগ রাখছেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-এর সঙ্গে।
এটিসি যখন জানাচ্ছে যে, কিছুক্ষণ পাপা ট্যাক্সি-বে দিয়ে বিমান যাতায়াতের সম্ভাবনা নেই, তখন বাসে করে লেভেল ক্রসিংয়ের গেট খুলে ওই মানুষদের নিয়ে আসা হচ্ছে মসজিদে। একই ভাবে তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট-ই এখন কলকাতার টুপিতে নতুন পালক।