• জেলবন্দির পিএইচডি, অর্ণবের আগেও লৌহকপাট ভাঙার একাধিক নজির দেশে
    এই সময় | ১৩ জুলাই ২০২৪
  • রাজেন্দ্রনাথ বাগ

    শিক্ষার অধিকার সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে স্বীকৃত জীবনের অধিকারেরই অঙ্গ। জেলে বন্দিরও সে অধিকার স্বীকৃত। সেই অধিকারেই বহু বন্দি জেলে বসে স্কুল ফাইনাল থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সময় যত এগিয়েছে, জেলে পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। তা বলে পিএইচডি? শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে হামলার মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অর্ণব দামের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে পিএইচডি করতে পারা, না-পারা নিয়ে বিতর্কের আবহে দেখা যাচ্ছে, কোনও জেলবন্দির পিএইচডি করার ঘটনা বিরল হলেও একাধিক অতীত নজির রয়েছে এ দেশে।বিহারের গয়া সেন্ট্রাল জেলে বন্দি অবস্থাতেই ২০১৩-য় মগধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন মহম্মদ সাজ্জাদ আলম। সুবিখ্যাত ‘আগ কা দরিয়া’ উপন্যাসের লেখক উর্দু সাহিত্যিক কুররাতুল আইন হায়দারের (১৯২৭-২০০৭) ছোট গল্প নিয়ে ছিল সাজ্জাদের গবেষণা। সাজ্জাদ ছিলেন খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি। বিস্তর বই জোগাড় করে দেওয়ার পাশাপাশি জেল কর্তৃপক্ষ সাজ্জাদের জন্যে কম্পিউটারেরও বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন।

    এমনকী সাজ্জাদের থিসিসের সুপারভাইজ়ার জেহানাবাদের এসএন সিংহ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মহম্মদ মজহার হোসেনের জন্যেও জেলের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনি বন্দি সাজ্জাদকে গবেষণার কাজে গাইড করতে আসতে পারেন। প্রসঙ্গত, বিহারের তিন ‘বাহুবলী’ রাজনীতিকও জেলে থাকাকালীন পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন—মহম্মদ সাহাবুদ্দিন, সুনীল পাণ্ডে এবং মুন্না শুক্লা।

    আবার খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মনোজ ইংলেকে ২০০৯-এ বম্বে হাইকোর্ট ৭০ দিনের বিশেষ প্যারোল দিয়েছিল (জেল কর্তৃপক্ষের মঞ্জুর করা ২০ দিনের অতিরিক্ত), যাতে তিনি নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি’র কোর্স ওয়ার্ক-সহ গবেষণার অন্য কাজ সহজে করতে পারেন। প্যারোল মঞ্জুর করতে গিয়ে বিচারপতি এনভি দাভোলকর এবং বিচারপতি এসপি দাভারের বক্তব্য ছিল, একজন বন্দির পিএইচডি করা অন্য বন্দিদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

    অওরঙ্গাবাদের পায়ঠান জেলে বন্দি অবস্থায় এলএলবিও করেছিলেন মনোজ। সেই সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে ডিপ্লোমাও। তার পর বিটেক এবং পিএইচডি’র গবেষণায় মন দেন। পড়াশোনার জন্যে একাধিক দফায় মনোজ প্যারোল পেয়েছিলেন তাঁর জেলজীবনে। ১৯৯৬-এর একটি খুনের ঘটনার বিচারে ২০০০ সালে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কর্নাটকের জেলে বন্দি পদ্মনাভ গৌড়াও গরাদের ওপারে থেকেই বিএ, বিএড, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাশ করেছিলেন।

    সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমাও অর্জন করেন জেলে বসে। তার পর এলএলবি করতে চাইলেও সে অনুমতি পাননি পুরোটাই অফলাইন কোর্স হওয়ায়। শেষ পর্যন্ত জেলে থাকাকালীন কর্নাটক স্টেট ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার অনুমতি পান। তাঁর থিসিসের শিরোনামটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ—‘সাজা এবং সংশোধন’।

    জেল যেখানে সংশোধনাগার, সেখানে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি কেন সংশোধনের সুযোগ পেয়ে অতীত ফেলে এগিয়ে যাবেন না উচ্চশিক্ষার হাত ধরে—বার বার সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। ভারতীয় কারা ব্যবস্থাও অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে। প্রফেসর কেজে সুরেশের অধীনে পিএইচডি করতে করতেই জেলে ১৫ বছর কাটিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন পদ্মনাভ।

    ড্রাগ-ট্যাফিকিংয়ের দায়ে আমেরিকার মিসৌরির জেলে এক দশকের বেশি কাটিয়ে বেরিয়ে স্ট্যানলি অ্যান্দ্রিজ এমবিএ এবং পিএইচডি করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই, ২০২১-এ প্রকাশিত ‘ফ্রম প্রিজ়ন সেলস টু পিএইচডি’ বেস্টসেলার হয়েছে। সাজ্জাদ, মনোজ, পদ্মনাভদের এগিয়ে যাওয়ার কাহিনীও কম মোটিভেশনাল নয়।
  • Link to this news (এই সময়)