প্রথম প্রয়োগ হল ‘অ্যাডভান্সড কেমোথেরাপি’, আরআইওতে ৩ বছরের ছোট্ট মেয়ের অসামান্য লড়াই
বর্তমান | ১৪ জুলাই ২০২৪
বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা: ছোট্ট পৃথা খেলতে ভালবাসে। ভালোবাসে বাবা-মায়ের আদর। বাড়তি পাওনা আট বছরের দিদির উপচে পড়া স্নেহ। পৃথার বয়স মোটে দু’বছর ন’মাস। ওর বাবার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, আরআইও’র ওয়ার্ডে আপন মনে খিলখিলিয়ে হাসছিল সে। হাসি দেখে কে বলবে, প্রাণঘাতী চোখের ক্যান্সারে আক্রান্ত ছোট্ট সরল মেয়েটি। তার বাঁ চোখটি বাদ দিতে হয়েছে। প্রাণশক্তি তাতেও কমেনি। হাসিতে, আধো আধো কথায় পৃথিবীকে সবসময় যেন জানান দিতে চাইছে—‘আমি হারিনি। হারবও না।’
বুধবার ছিল আরআইও’র ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন। বাংলার চোখের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ঐতিহাসিক দিন। পৃথার (নাম অনুমতিক্রমে প্রকাশিত) বাঁ চোখ নষ্ট করে ক্ষান্ত হয়নি সর্বগ্রাসী ক্যান্সার। বায়োপসি করাতে গিয়ে ধরা পড়ে ডান চোখেও ছড়িয়েছে মারণ রোগ। তা নির্মূল করতে ওদিন মেডিক্যাল কলেজের তিন বিভাগ এবং আরআইও’র চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের মেধা, উদ্যম দিয়ে বাংলায় প্রথম চোখের ক্যান্সারে ‘অ্যাডভান্সড কেমোথেরাপি’ প্রয়োগ করলেন। আর আবারও প্রমাণিত হয়, ক্যান্সার মানেই হার নয়। মৃত্যু নয়।
মেডিক্যাল কলেজে চোখের চিকিৎসার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অবথালমোলজি (আরআইও) সূত্রে খবর, নয়া প্রযুক্তির ‘অ্যাডভান্সড কেমোথেরাপি’ নাম হল ‘ইনট্রা অবথালমিক আর্টারি মেলফালান’। এই পদ্ধতিতে সরাসরি ক্যান্সার আক্রান্ত চোখের টিউমারে (রেটিনোব্লাস্টোমা) কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর, ক্যান্সার চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে কাজটা করতে হয়। তাই বুধবার অপারেশনের সময় আরআইও’র চিকিৎসকরা ছাড়াও ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অঙ্কোলজি ও রেডিওথেরাপি’র ডাক্তাররাও। বুধবার প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে প্রক্রিয়াটি চলে।
শুক্রবার আরআইও’র অধিকর্তা ডাঃ অসীম ঘোষ বলেছিলেন, ‘কমপক্ষে চারটে সিটিং লাগবে। প্রথম সিটিং হল। শুধু আরআইও নয়, এই কাজ বাংলা তথা পূর্ব ভারতে এই প্রথম হল। প্রাইভেটে সর্বসাকুল্যে এই চিকিৎসায় খরচ পড়বে ১০ লাখ টাকারও বেশি। এখানে হচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। নয়া প্রযুক্তিতে সাফল্যের হার প্রায় ৮০ শতাংশ। আশা করছি, ছোট্ট মেয়েটির মুখের হাসি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারব।’ প্রসঙ্গত, প্রতি ১৫ হাজার প্রসবে একটি শিশু চোখের ক্যান্সার রেটিনোব্লাস্টোমা নিয়ে জন্মায়। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিয়ে হলে, বেশি বয়সের পুরুষ-নারী বিয়ে করলে এই জাতীয় জিনগত বিপদের আশঙ্কা থাকে। এই ক্যান্সার চোখের রেটিনাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে কেমোথেরাপিতে ভালো কাজ হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে ইন্ট্রাভেনাস পদ্ধতিতে শিরাসমষ্টির মধ্যে দিয়ে, হার্টের মধ্যে দিয়ে চোখের টিউমারে পৌঁছত কেমো। তাতে দীর্ঘ সময় লাগত। নয়া পদ্ধতিতে অত্যন্ত দ্রুত ক্যারোটিড ধমনির পাশেই চোখের অবথালমিক ধমনি দিয়ে টিউমারে পৌঁছে যায় কেমো ইঞ্জেকশন। কিন্তু কতটা পরিমাণে, কতক্ষণ ধরে কেমো দেওয়া হবে, তা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। তাই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
পৃথা খেলছিল। টানা দু’বছর ধরে তার ক্যান্সার যুদ্ধের সাক্ষী, সহযোদ্ধা বাবা বিপ্রদাস হালদার দেখছিলেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সিদ্ধিবেড়িয়ার বাসিন্দা বিপ্রদাসবাবু বললেন, ‘জানি ও ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে। আরআইও’র ডাঃ সৌম্যদীপ মজুমদার সহ অন্যান্যরা নিজেদের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন। এক পয়সাও খরচ হয়নি আমাদের। ও সুস্থ হলে আমাদের লড়াই সার্থক হবে।’