কলকাতা এবং শহরতলির বিভিন্ন বাজারে কাঁচালঙ্কার দাম এখন কেজি প্রতি ১৫০-১৬০ টাকা। সরকারি ‘সুফল বাংলা’ স্টলে তার দাম ১১০। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে চাষিরা স্থানীয় বাজারে সেই লঙ্কাই বিক্রি করেছেন ৮০-৮৫ টাকায়। একই আনাজ। কিন্তু দামের এত রকমফের? কাঁচা লঙ্কা এক্ষেত্রে প্রতীকী, সমস্যাটা কিন্তু সব আনাজের ক্ষেত্রে এক রকম।সরকারি স্টলের আনাজ সরাসরি চাষিদের থেকে কেনা হয়। সমস্যাটা বোঝা যায় খুচরো বাজারে গিয়ে। চাষি থেকে খুচরো বিক্রেতা— সকলে দাবি করেন, আনাজের দাম নির্ভর করে জোগান এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের উপরে। যাঁদের আর এক পরিচয় ‘ফড়ে’। মাঠ থেকে চাষিরা কোন আনাজ কত পরিমাণ আনতে পারছেন, তার উপরেই পাইকারি বাজারগুলিতে আনাজের দাম নির্ধারিত হয়।
ফলন কম হলে এমনিতেই দাম চড়ে। তা বলে বেগুন ১৬০ ছোঁবে! যার পাইকারি দাম ৭০ টাকা কেজি। খুচরো বাজারের এই ভেলকি কি তা হলে ‘ম্যান-মেড’? বাজারে নেমে তার উত্তর পেয়ে গিয়েছেন সরকারের তৈরি করা এই সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের সদস্যেরা। পর পর দু’দিনে তিন বাজারে হানা দেওয়ার পরে ওই একই বেগুন নেমে এসেছে ১০০ টাকারও নীচে।
শহরে আনাজ আসে গাঁ-গঞ্জের হাট থেকে। উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার হাটে সাধারণত দু’হাজার চাষি গড়ে ১৫০০-২০০০ মণ আনাজ আনেন। আনাজের আমদানি বাড়লে ফড়েরা দাম কমিয়ে দেন। চাষিদের কাছ থেকে আনাজ নিয়ে আড়তদারেরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিক্রি করেন। তাঁরা কেনা দামের উপরে ২ শতাংশ লাভ রাখেন। এর বাইরেও রয়েছেন আরও এক ধরনের কারবারি। তাঁরা স্থানীয় ফড়ে।
স্থানীয় ফড়েরা আবার ছোট চাষিদের কাছ থেকে আনাজ কিনে নেন অনেক কম দামে। অন্যদিকে, এই ধরনের অনেক চাষির ফসল এক সঙ্গে হাটে আনতে ফড়েদের খরচও কম পড়ে। সে জন্য ছোট চাষিরা মার খাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের যুক্তি, ঝাড়াই-বাছাই করে আনাজ গাড়িতে তোলা, মজুরের খরচ, আনা-নেওয়ার ফলে কিছু আনাজ নষ্ট হওয়া, এ সব কারণে লাভ পোষাতে দাম বাড়ে। এর বাইরে রাস্তায় অনেককে টাকা দিতে হয়। সেই চাঁদার খরচও চেপে বসে আনাজের দামে।
খুচরো ব্যবসায়ীরা পাইকারি বাজার থেকে কেনার পরে দর আরও কিছুটা বাড়িয়ে বাজারে তা বিক্রি করছেন। শুধু ফড়েরা নন, অভিযোগ এখানেও রয়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারে যোগান কমলে দাম বাড়ে। এই সুযোগে খুচরো ব্যবসায়ীরাও ঝোপ বুঝে কোপ মারতে দাম অনেকটাই বাড়িয়ে আনাজ বিক্রি করেন। টাস্ক ফোর্সের এক সদস্য বলছেন, পুরো দোষটা ফড়েদের ঘাড়ে এসে পড়লেও সেটা কিন্তু ঘটনা নয়।
খুচরো ব্যবসায়ীরা যে ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন, তা হাতেনাতে ধরাও পড়ছে। কারণ, যে শসা মানিকতলা বাজারে ৬৫ টাকা কেজি, সেটাই কাঁকুড়গাছি ভিআইপি বাজারে ১০০ টাকা। অন্য আনাজের ক্ষেত্রেও তাই। অথচ, তা আসছে একই পাইকারি বাজার থেকে। তা হলে হিসেবটা দাঁড়াচ্ছে এ রকম— গাঁট কাটা যাচ্ছে আমজনতার, অন্যদিকে খেতের ফসলের দাম পাচ্ছেন না চাষিরাও।
এই অব্যবস্থা কিন্তু আজকের বা এক দিনের নয়। সেই বাম আমলে চিহ্নিত করা গিয়েছিল এই রোগ। তার দাওয়ায় হিসেবে এসেছিল ‘কিসান মান্ডি’ কনসেপ্ট। যেখানে চাষিরা সরাসরি খেতের ফসল আনবেন, এবং পাইকারেরা সেখান থেকে ন্যায্য মূল্যে আনাজ কিনবেন। মাঝে কেউ থাকবে না। ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতে থাকা কৃষি বিপণন দপ্তরের সেই মান্ডি নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না। তৃণমূল জমানায় বহু অসমাপ্ত মান্ডির কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সমস্যাটা রয়েই গিয়েছে। তা হলে গলদটা কোথায়? (চলবে)