লোকসভা ভোটের পর চার বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনেও বিপর্যয় অব্যাহত। তবে চোয়াল শক্ত করে বঙ্গ-বিজেপি নেতৃত্ব এখনও বলছেন, 'এই পরিস্থিতি দ্রুত কাটিয়ে উঠব আমরা।' কিন্তু কী উপায়? কোন যাদুমন্ত্রে আবার গেরুয়া ঝড় উঠবে বঙ্গ-রাজনীতিতে? কে শক্ত হাতে ধরবে দলীয় সংগঠনের লাগাম?লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর একমাস কেটে গিয়েছে। এই প্রশ্নগুলির সদুত্তর এখনও খুঁজে চলেছে বিজেপি। আগামী ১৭ তারিখ দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে ভবিষ্যৎ রণকৌশল ঠিক করার কথা। তার আগে উপ-নির্বাচনের ফলাফলে আরও একপ্রস্থ ধাক্কা খেতে হলো পদ্ম-ব্রিগেডকে। মানিকতলা, বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ এবং রায়গঞ্জ-চারটি বিধানসভা কেন্দ্রেই তৃণমূলের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছেন গেরুয়া প্রার্থীরা।
এর মধ্যে মানিকতলা ছাড়া বাকি তিনটি আসনই এতদিন ছিল বিজেপির দখলে। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটেই শুধু নয়, এ বারের লোকসভা ভোটেও এই তিন বিধানসভা আসনে তাদের লিড ছিল। মাত্র একমাসের ব্যবধানে উপ-নির্বাচনে বিজেপির এই শক্ত ঘাঁটিগুলিতে নিজেদের ঝাণ্ডা উড়িয়ে দিল তৃণমূল। সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীরা ভোট-প্রচারে বিস্তর ছোটাছুটি করেও একটা গড়ও রক্ষা করতে পারলেন না।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-এর তুলনায় এই উপ-নির্বাচনে রায়গঞ্জে বিজেপির ভোট কমেছে ২৫ শতাংশ। রানাঘাট দক্ষিণে ১৩ শতাংশ, বাগদায় ১২ শতাংশ, আর মানিকতলা কমেছে ৩৩ শতাংশের সামান্য বেশি। ফলে হাওয়া যে ভালো নয় তা উপ-নির্বাচনগুলির ফলাফল পর্যালোচনা করে বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন বঙ্গ-বিজেপি নেতৃত্ব। দলের রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য নির্বাচনী বিপর্যয়ের জন্য সন্ত্রাসকে দায়ী করেও নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি অস্বীকার করতে পারছেন না।
তাঁর বক্তব্য, 'তৃণমূল ভোটের মেশিনারি তৈরি করেছে। সাম্প্রতিককালে ভোটের সংগঠন বলতে যা বোঝায়, সেটা আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। এই ফলাফল তারই প্রমাণ।' তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট-সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেও শমীক ঠারেঠোরে বিজেপিকেও আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কথায়, 'কী ভাবে মানিকতলার ভোট হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছে। ওয়ার্ডের পর ওয়ার্ড অবরুদ্ধ করে ভোট হয়েছে। আমি হারের জন্য অজুহাত দিচ্ছি না। সবটাই সন্ত্রাসের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমাদের ভুল-ত্রুটি, আমাদের বিচ্যুতি উপেক্ষা করতেও চাইছি না। সেগুলি আমরা ঠিক করব। পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।'
কোন 'চিকিৎসা পদ্ধতি'তে বিজেপি নেতৃত্ব 'সাংগঠনিক অসুখ' নিরাময় করবেন, তা শমীক খোলসা না করলেও উপ-নির্বাচনের ফলাফলের পরে সাংগঠনিক রদবদলের দাবি আরও জোরালো হয়েছে।
বিজেপির এক প্রবীণ নেতার কথায়, 'চার কেন্দ্রে ভোট-প্রচার করতে যেতে দেখা যায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অথচ আমাদের প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচার করতে ছুটে গিয়েছিলেন দলের দুই প্রধান মুখ সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারী। এমনকী, রায়গঞ্জে একসঙ্গে মিছিলে হেঁটেছিলেন শুভেন্দু-সুকান্ত। এরপরেও ভরাডুবি হয়েছে। এ থেকেই স্পষ্ট নেতৃত্বে বদল প্রয়োজন।'
বিজেপি নেতৃত্বের ধারণা, সাংগঠনিক দুর্বলতাই পরাজয়ের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি, লোকসভা ভোটের মতো উপ-নির্বাচনেও 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' বড় ফ্যাক্টর বলে মনে করছেন তাঁরা। এক বিজেপি নেতার কথায়, 'লক্ষ্মী ভাণ্ডারের কাছে আমাদের যাবতীয় রণকৌশল মুখ থুবড়ে পড়ছে।'
তবে বিজেপির বড় অংশেরই অভিমত, ঘুরে দাঁড়াতে গেলে একসূত্রে বাঁধতে হবে গোটা দলকে। শুভেন্দু-বিজেপি, সুকান্ত-বিজেপি, দিলীপ-বিজেপির বাইরে বেরিয়ে দলের নিচুতলাকে ঐক্যবদ্ধ-বিজেপির বার্তা দেওয়াই এখন প্রথম কাজ বলে অভিমত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘেরও (আরএসএস)। সঙ্ঘের এক বর্ষীয়ান নেতার ব্যাখ্যা, 'মানুষের ভরসা এ ভাবে হারাতে থাকলে বাংলায় ফের সাইনবোর্ড পার্টি হয়ে যাবে বিজেপি। বাংলার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে চাইলে নেতারা গদির দখল নিয়ে চুলোচুলি বন্ধ রাখুন।'