জমানা বদলেছে। অনেকগুলি অসমাপ্ত-অর্ধসমাপ্ত সরকারি বাড়ি এখন নীল-সাদা রঙের কিষান মান্ডি। চাষিদের সুবিধার্থে ওই বাড়িগুলোয় নিয়মিত বাজার বসার কথা ছিল। এই মান্ডিতে বিক্রেতা-ক্রেতার মাঝে কারও থাকার কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। সেখানে কোথাও এখন কাঠের আসবাব, প্লাইউডের জিনিসের সম্ভার। কোনওটা আবার বিলকুল শুনশান।বহু কোটি টাকা ব্যয়ে গড়া এই কিষান মান্ডিগুলোর একটা বড় অংশ কার্যত চাষিদের কাজে আসছে না বুঝে নানা ভাবে সেগুলোকে সচল করতে চাইছে প্রশাসন। তবে চাষিরা বলছেন, 'গোড়ায় গলদ। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা- দু'পক্ষই সহজে যেতে পারেন, তেমন জায়গায় মান্ডি বানালে এমন হতো না।'
বীরভূমের কথাই ধরা যাক। জেলায় কিষান মান্ডি ১৩টি। এখানে বহুমুখী প্রকল্প করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই কাজ শুরু হলেও তা শেষ করা যায়নি। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিষান মান্ডিগুলি যে এলাকায় তৈরি করা হয়েছে, সেগুলি না-শহর, না-গ্রাম। চাষিরা কেবল সেখানে ধান নিয়ে গিয়ে সরকারি দরে বিক্রি করেন। আনাজের ক্ষেত্রে তাঁদের ভরসা হয় সেই আড়তদার, নয় তো স্থানীয় ফড়ে।
সমস্যাটা সারা রাজ্যে একই রকম। কেবল জেলার নাম বদলে যায়। হুগলির পুরশুড়া কৃষক বাজারে চাষিদের আনাগোনা নেই। সেখানে বিক্রি হয় কাঠের আসবাব, প্লাইউডের জিনিস। হাওড়ায় পাঁচটি কিষান মান্ডির মধ্যে চালু একটি (বাগনান), বাকি চারটি ফাঁকা।
একই ছবি দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর দিনাজপুর বা নদিয়ায়। উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার রেগুলেটেড মার্কেট কমিটির তৈরি কিষান মান্ডিটি (চিত্ত বসু বাজার) উত্তর ২৪ পরগনার অন্যতম প্রধান বাজার। বাম আমলেই এটি তৈরি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ছিল। চালু হলেও এখন তা প্রায় বন্ধই। কিছু স্টল ভাড়া দেওয়া রয়েছে।
পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের আজিজুল হক কিংবা মেমারির সাধন ঘোষের বক্তব্য, 'গ্রাম থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে মান্ডি, তাও আবার শহরেরও অনেক বাইরে। ভ্যানে করে আনাজ নিয়ে যেতে খরচ অনেক।' ঠিকঠাক জায়গায় মান্ডি হলে যে সব পক্ষই লাভবান হতে পারে, তার উদাহরণ- সিঙ্গুর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমি-আন্দোলনের ক্ষেত্র সিঙ্গুরে ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে কিষান মান্ডি চালু হয়। বাজারটি সিঙ্গুরের রতনপুরে বৈদ্যবাটী-তারকেশ্বর রোডের ধারে।
ধারেকাছে কামারকুণ্ডু এবং সিঙ্গুর স্টেশন। ঢিল ছোড়া দূরত্বে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে দিল্লি রোড এবং জিটি রোড। সড়ক ও রেল যোগাযোগ ভাল হওয়ায় সহজেই কলকাতা-সহ অন্য জায়গায় পৌঁছনো যায়। আশপাশের চাষিরা সেখানে ফসল নিয়ে আসেন। তাঁরা জানান, সুফল বাংলার আনাজ এখান থেকে কেনে রাজ্য সরকার। ব্যবসায়ীরাও আসেন আনাজ কিনতে।
একটা কথা অবশ্য সকলেই মানছেন যে, হাট বা বাজারের কাছে মান্ডি করার জন্য জায়গা সর্বত্র মিলবে না। সে ক্ষেত্রে সমাধান কী? চাষি এবং ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, তেমন হলে শহর বা গঞ্জ এলাকায় না করে গ্রামাঞ্চলের যে সব এলাকায় আনাজ বেশি হয়, সেখানে মান্ডি তৈরি করলে চাষিদেরও সুবিধা হবে। তা জনপ্রিয়ও হবে।
এই পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদে ২১টি মান্ডির পড়ে থাকা অংশে কৃষি বিপণন ও পার্ক গড়ার উদ্যোগ চলছে। পূর্ব বর্ধমানের গলসি-১ ব্লকের কিষান মান্ডিকে 'মডেল' করে কৃষিভিত্তিক শিল্প-তালুক গড়ার দিকে এগোতে চাইছে জেলা। বাঁকুড়ায় কিষান মান্ডিগুলিকে আংশিক ও সম্পূর্ণ- দু'ভাবেই 'লিজ' দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, হিমঘর, রাইসমিল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কাজে ব্যবহার করার উদ্যোগ সরকারি-বেসরকারি দু'তরফেই চলছে।
চাষিদের আর একটি দাবিও দীর্ঘদিনের। তা হলো মাল্টি চেম্বারড কোল্ড স্টোরেজ বা বহুমুখী হিমঘর তৈরি। সে ক্ষেত্রে বেশি ফলন হলে বাধ্য হয়ে আনাজ বেচে দিতে হবে না। হিমঘরে রেখে অসময়ে তা বিক্রি করে তাঁরাও কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পারবেন। বলাই বাহুল্য, এই সংক্রান্ত বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীও কৃষি দপ্তরকে এই ধরনের হিমঘর তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন।
কিষান মান্ডিও নয় আবার হাটও নয়, এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে কোথাও কোথাও নতুন এক ধরনের ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। এই দুই সিস্টেমকে এড়িয়ে দিব্যি চাষির ফসল পৌঁছে যাচ্ছে শহরের বাজারগুলিতে। তাতে চাষিরাও দাম বেশি পাচ্ছেন, আবার হাত পুড়ছে না মধ্যবিত্তদেরও। নতুন এই পদ্ধতিই স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষকদের। (চলবে)