দেগঙ্গার চাষি রহমত শেখের খেতের ১৫ টাকা দরের পটল কলকাতার বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। আবার, দেগঙ্গারই সুদর্শন মণ্ডল তাঁর খেতের পটল ৩০ টাকায় বিক্রি করছেন! কিন্তু দামের এই ফারাক কেন?পার্থক্য হলো — রহমত আনাজ বেচেন দেগঙ্গা বা বেড়াচাঁপা হাটে। আর একটি ফার্মার প্রোডিউসার কোম্পানি (এফপিসি)-র সদস্য-সম্পাদক হওয়ায় অনেক বেশি দামে আনাজ বিক্রি করতে পারেন সুদর্শন। তিনি একা নন। ওই সংস্থার ৩৭৬ জন সদস্যই অসাধু পাইকারি ব্যবসায়ীদের এড়িয়ে নিজেদের আনাজ নিজেরাই বাজারজাত করছেন।
যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে চাষিরা এক কেজি পটলের জন্য অন্তত ২৫ টাকা পাচ্ছেন বলে জানান সুদর্শন। মাঠ থেকে আনাজ বাজারে পাঠানোর ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে কার্যকরী বিকল্প বলে মনে করছেন কৃষকরা। ফড়েদের নাগাল এড়িয়ে এমন এফপিসি বা কৃষক-কৃষি ব্যবসায়ী সঙ্ঘের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা চলছে উত্তর ২৪ পরগনার বেশ ক’টি ব্লকে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়েও আছে এমন এক এফপিসি, যা দেশের মধ্যে প্রথম এমন সংস্থা। এ ছাড়া দুই মেদিনীপুর, হাওড়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদেও এমন সংস্থা আছে। আমডাঙা-বনগাঁ-দেগঙ্গার কৃষকরা জানাচ্ছেন, লকডাউনের সময়ে কার্যত অসাধ্যসাধন করে পথচলা শুরু সংস্থাগুলির। তখন পরিবহণের সমস্যা থাকায় এফপিসিগুলির পাশে দাঁড়ান উত্তর ২৪ পরগনার তৎকালীন সহ-উদ্যানপালন অধিকর্তা শুভদীপ নাথ।
তিনি কলকাতার কিছু স্বনির্ভর গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রিত বাজার এবং সরকারি স্টলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ফলে ওই কৃষকদের আনাজ সরাসরি কলকাতায় পৌঁছয়। বেশি দামও মেলে। এমন সংস্থার প্রাথমিক নীতিই হলো, জমির পরিমাণ অনুযায়ী লাভের বণ্টন। এবং এই নীতি উৎসাহিত করছে কৃষকদের। সংস্থাগুলি আসলে কেন্দ্রের একটি প্রকল্পের আওতাধীন। ২০১১-১২ সালে এর পাইলট প্রকল্প চালু হয় ভাঙড়ে।
সেখানে এখন সদস্য হাজার দুয়েক। এই সংস্থা প্রথম বিদেশে আনাজ রপ্তানিও শুরু করে। এখন সে পথে হাঁটছে বাকিরাও। এই দু’হাজার চাষির মোট জমি প্রায় এক হাজার একর। তাঁদের নিয়ে শতাধিক গ্রুপ হয়েছে। সদস্যদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পরিচালন সমিতি ও পরিচালন পর্ষদ-ও গঠিত হয়েছে।
এই সংস্থা লাভজনক হলে সর্বত্রই তা হচ্ছে না কেন? কৃষি দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, ‘যে সব জেলায় আনাজের উৎপাদন বেশি, সেখানেই এমন সংস্থা তৈরি হচ্ছে। আসলে সংস্থা গঠনে এলাকার বহু চাষিকে একত্র করতে হয়। দপ্তরের অফিসারেরা সেটা করছেন। এতে সময় লাগে। নথিপত্র তৈরি করে অনুমোদন-রেজিস্ট্রেশনেও সময় লাগে। সেই চেষ্টা সর্বত্রই চলছে।’
চাষিদের আনাজ বিক্রি থেকে সার-বীজ-কৃষি সরঞ্জাম বাজারের চেয়ে কম দামে সদস্যদের বিক্রি করে ভাঙড়ের সংস্থাটি। সরকারি ‘সুফল বাংলা’র স্টল থেকে শুরু করে কিছু বাজার এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও আনাজ সরবরাহ করে এই সংস্থা। বিক্রির টাকা জমা পড়ে চাষিদের অ্যাকাউন্টে। এখন মুদিদ্রব্য এবং দুগ্ধজাত পণ্যও তৈরি করছে তারা।
সদস্য ইজ়রায়েল মোল্লা, আসাদুল ইসলামরা বলেন, ‘আমাদের চিন্তা কমেছে, আনাজের বেশি দাম পাচ্ছি।’ একই বক্তব্য, আমডাঙার সহিদুল মোল্লা, আসলাম গাজি, গোবিন্দ বিশ্বাসদের। তবে বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি। লক্ষ লক্ষ চাষি আজও সেই হাট বা বাজারেই ভরসা রাখেন। চাষিদের বড় অংশকে এমন সংস্থার আওতায় আনা দরকার।’