• মাসে এক টাকা দক্ষিণা সমীরণের পাঠশালায়
    এই সময় | ১৬ জুলাই ২০২৪
  • সূর্যকান্ত কুমার, কালনা

    অবসর নিয়েছেন ২০২১ সালে। তবে এখনও ছুটি নেননি মাস্টারমশাই। মাসে এক টাকার দক্ষিণায় অঙ্ক থেকে ইংরেজি— সব বিষয়ের মুশকিল আসান করেন ছাত্রছাত্রীদের। কালনার কৃষ্ণদেবপুরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীরণপ্রসাদ চক্রবর্তীর ‘ষোলো আনার পাঠশালায়’ ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত এলাকার অভাবী পরিবারের অভিভাবকরা। তবে শুধু পড়ালাম আর ছাত্রছাত্রীরা পড়ে চলে গেল ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয় না, তাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ করে তোলার পাঠও দেন সমীরণ।কালনা ৩ নম্বর চক্রের বাদলা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কৃষ্ণদেবপুর হালদারপাড়ার বাসিন্দা সমীরণ। ২০১৮ সালে বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিস থেকে চক্রের সেরা শিক্ষকের সম্মান পান। ছাপার অক্ষরের মতো হাতের লেখা হওয়ায় সরকারি অনুষ্ঠানে ডাক পেয়েছেন শংসাপত্র লেখার জন্য। বাবা কমলাপ্রসাদ চক্রবর্তীও ছিলেন শিক্ষক। ছেলে সৌম্যদীপ পিএইচডি করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

    ২০২১-এর নভেম্বরে অবসর নেওয়ার পরই সমীরণ ঠিক করেন, মাসিক এক টাকা গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াবেন তিনি। তখন থেকেই বাড়ির একটি ঘরে সোম থেকে শুক্রবার সকালের ব্যাচে পড়ান প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের। আর সন্ধ্যার ব্যাচে পড়ান ক্লাস ফাইভ থেকে নাইনের পড়ুয়াদের। বর্তমানে দু’টি ব্যাচ মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪০। স্যরের ঘরে রাখা একটি ভাঁড়ে মাসের শেষে ১ টাকা করে দক্ষিণা দিয়ে যায় ওরা।

    সমীরণ জানান, সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে তাঁর এই উদ্যোগ। যার অনুপ্রেরণা ২ টাকার শিক্ষক হিসেবে পরিচিত সুজিত চট্টোপাধ্যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০২১ সালে পদ্মশ্রী পান আউশগ্রামের উত্তর রামনগরের বাসিন্দা সুজিত চট্টোপাধ্যায়। অশীতিপর এই শিক্ষক বয়সের ভারে এখন আর পড়াতে পারেন না।

    তবে একসময়ে রোজ তিনশোরও বেশি পড়ুয়া পড়াতেন তাঁর বাড়ির ‘সদাই ফকিরের পাঠশালায়’। দক্ষিণা বছরে দু’টাকা। সেই টাকাও সবটা তিনি খরচ করতেন পড়ুয়াদের পিছনে। তেমনই ইচ্ছে রয়েছে সমীরণেরও। তিনি বলেন, ‘ভাঁড় প্রায় ভরে এসেছে। এবার ভাঙব। সেই টাকা ছেলেমেয়েদের কাজেই লাগাব।’

    বাবার প্রয়াসে খুশি ছেলে সৌম্যদীপ। তাঁর কথায়, ‘বাবার কাছ থেকেই শৃঙ্খলাপরায়ণ হওয়া শিখেছি। তাতে ফলও মিলেছে। সময় পেলে পাঠশালায় গিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করি।’ ‘ষোলো আনার পাঠশালার’ ক্লাস নাইনের ছাত্রী ত্রিপর্ণা রায় স্কলারশিপ পেয়েছে। তার বক্তব্য, ‘স্কলারশিপের জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্বই স্যরের। যখন যেটা জানতে চাই স্যর হাসিমুখে বুঝিয়ে দেন।’

    অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিমি মণ্ডল বলে, ‘স্যর আমাদের জন্য ঘরে পেন, খাতা রেখে দেন। কেউ আনতে ভুলে গেলে বা সঙ্গে না-থাকলে ওখান থেকেই আমরা নিয়ে নিই।’ এক অভিভাবক তাপস রায় বলেন, ‘পড়ানোর নামে যে সমাজে ব্যবসা চলে সেখানে সমীরণ স্যর একজন দৃষ্টান্ত। তিনি রয়েছেন বলেই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করি না।’
  • Link to this news (এই সময়)