সুখেন্দু পাল, বর্ধমান: একজন বন্দুকের নলে ক্ষমতার উৎস্য খুঁজতেন। ছিপছিপে গড়ন। হাতে একে ৪৭। একদা তাঁর পদধ্বনীতে কেঁপে উঠত তামাম জঙ্গলমহল। মাইন বিস্ফোরণ, অপহরণ, হত্যা...লাশের পর লাশ!
অন্যজন ছিলেন প্রেমে পাগল। জড়িয়ে গিয়েছিলেন বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে। পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বামী। তাঁকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র। পরিকল্পনায় সফল। ফোনে স্বামীর মৃত্যু-যন্ত্রণার আর্তনাদ শুনে আহ্লাদে আটখানা!
দু’জনের উদ্দেশ্য ছিল একেবারে ভিন্ন। প্রথমজন মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। দ্বিতীয়জন মনুয়া মজুমদার বিভোর ছিলেন জীবন বদলের। আর এখন দু’জনেই বর্ধমানের সংশোধনাগারে। উদ্দেশ্য একটাই—অতীত ভুলে তাঁরা সংশোধিত হতে চান। ফিরতে চান সমাজের মূলস্রোতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইতিহাসের উপর গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছেন অর্ণব। সেই সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহারে উঠেপড়ে লেগেছেন তিনি। তাই, সারাক্ষণ দেশ-বিদেশের ইতিহাস খুঁড়ে চলেছেন একদা খড়্গপুর আইআইটি’র কৃতী পড়ুয়া। মনুয়া নাচ ভালোবাসেন। ছোট থেকেই নাচের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। ক্ল্যাসিক্যালেই বেশি স্বচ্ছন্দ। সংশোধনাগারে সেই নাচকেই জীবন বদলানোর মূলমন্ত্র করেছেন। খোঁজ পেয়েছেন অপার শান্তির। নিজে নিয়মিত অনুশীলন করেন। অন্য বন্দিদেরও শেখান। অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। কেউ বলে দিলে বোঝা যায় না, মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন সেই মনুয়া।
জেল সূত্রে খবর, অর্ণব ক’ দিন আগেই হুগলি থেকে বর্ধমান সংশোধনাগারে এসেছেন। আসার সময় তাঁর ব্যাগে গাদাগুচ্ছের বইপত্তর। সেগুলি পড়াশোনা করেই সময় কাটাচ্ছেনো। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সিলিং হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার ফিজ জমা দিয়ে ভর্তি হবেন অর্ণব। সেদিন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির না থাকলেও অসুবিধে নেই। অনলাইনে ফিজ জমা দিলেই চলবে। কাউন্সিলিংয়ে এসে সংবাদমাধ্যমকে উদ্দেশ্যে করে অর্ণব বলেছিলেন, ‘এরপর আপনারা শুধু পড়াশোনার বিষয় জানতে আসবেন। অন্য কিছু গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল।’ অর্থাৎ, বন্দুকের ট্রিগার টেপা ভুলেছেন অনেক আগেই। এবার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়টুকুও ভুলতে চান মাওবাদী শীর্ষনেতা।
জেল বন্দিদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন মেহেবুব হাসান। তিনি বলছিলেন, ‘১৫ আগষ্ট, স্বাধীনতা দিবসের দিন একটি অনুষ্ঠান রয়েছে। মনুয়া সহ অন্যানদের নিয়ে বৃহস্পতিবার থেকেই রিহার্সাল শুরু হবে। ও খুব ভাল নাচ করে। অন্যান বন্দিদেরও উৎসাহিত করেন। বর্ধমানেও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন।’ জেলের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, সেই মনুয়া আর এই মনুয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সবসময় নাচ, গান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পুরনো কথা তুলতে চান না। সংশোধানাগারে সত্যিই সংশোধিত হয়েছেন। এখন নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেন।’
আলোচনার প্রসঙ্গে উঠে আসে ‘গোল্ডেন ডাকু’ সুবোধ সিংয়ের কথা। তাকে হুগলি জেল থেকে বর্ধমান সংশোধনাগারে আনা হয়েছে। এক আধিকারিকের কথায়, ‘সুবোধরা জেলকে অন্য চোখে দেখে। এরা জেলে বসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অপারেশনের ছক কষে। হাজার চেষ্টা করলেও এদের সংশোধন করা কঠিন। সুবোধদের কাছে জেলের সংজ্ঞা অন্য।’