• অর্ণব
    এই সময় | ১৮ জুলাই ২০২৪
  • কথোপকথনটি নাটকীয় মনে হলেও বাস্তবে এমনটাই ঘটেছে বলে সূত্রের দাবি। এক পুলিশকর্মীর আশঙ্কায় জবাব দিয়েছেন এক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। সোমবার দুপুরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপবাগ ক্যাম্পাসে তখন সবেমাত্র বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের একটি কালো রংয়ের প্রিজ়ন ভ্যান এসে পৌঁছেছে। অতীত ধরলে ভিতরে রয়েছেন প্রাক্তন মাওবাদী নেতা বিক্রম। ২০১০ সালে যাঁর নেতৃত্বে শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে চালানো হামলায় শহিদ হন ২৪ জন জওয়ান।আর বর্তমান বলছে, প্রিজ়ন ভ্যানে রয়েছেন ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি-র ছাত্র। যে তাঁর যাবজ্জীবন কারাবাসের রায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন কলকাতা হাইকোর্টে। অতীত-বর্তমানের টানাপড়েনের মাঝে আচমকা আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। ততক্ষণে খোলা হয়েছে প্রিজ়ন ভ্যানের কলাপসিব্‌ল গেট। সূত্রের খবর, এমন সময়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘বৃষ্টি হচ্ছে, ভিজে যাবেন তো।’

    প্রিজ়ন ভ্যান থেকে নামার ঠিক আগের মুহূর্তে জবাবে অর্ণব বলেন, ‘বৃষ্টির জলে পাপ ধুয়ে যাবে।’ এর পর আর কোনও কথাই বলেননি তিনি। নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপে কাউন্সেলিংয়ের জন্য সোজা ঢুকে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাদম্বরী মেমোরিয়াল হলে। শিলদার ঘটনা ছাড়াও একসময়ে ৩১টি গুরুতর মামলা ছিল অর্ণবের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালে আসানসোলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর সেই সব দিন পেরিয়ে ক্রমেই পড়ালেখার দিকে মন বসে অর্ণবের।

    মেদিনীপুর সংশোধনাগার থেকে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে আসার পর ইগনুর মাধ্যমে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর হন। দু’টিতেই ফার্স্ট ক্লাস পান খড়্গপুর আইআইটি-র এই প্রাক্তনী। ২০১৮ সালে স্লেট (স্টেট লেভেল এলিজিবিলিটি টেস্ট) পাশ করেন। কারা দপ্তর সূত্রের খবর, হুগলি সংশোধনাগারে থাকার শেষ ৫-৬ মাস ধরে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে অর্ণবের। তা হলে কি এবার বিক্রমকে মুছে ফেলে নতুন কাহিনি লিখবেন অর্ণব?

    উত্তর মিলতে সময় লাগবে। অর্ণবকে খুব কাছ থেকে দেখা কারা দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, ‘অর্ণব যখন বিক্রম তখন তাঁর চালচলন, কথা বলার ভাষা সমস্ত কিছুর মধ্যেই ছিল সমাজবদলের স্বপ্ন। ক্রমেই বিক্রমের ছবি মুছে যেতে থাকে। পরে দেখতাম এক মেধাবী ছাত্রকে। যাঁর হাতে সবসময় বই থাকত। বিক্রমের কালো মেঘ কেটে অর্ণব তখন বৃষ্টি নামাতেন।’

    ‘বৃষ্টির জলে পাপ ধুয়ে যাবে’— অর্ণবের মুখে এই কথা কেন? বর্ধমান ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ তনভির নাসরিন বলেন, ‘আমি জানি না অর্ণব কোন পাপের কথা বলেছেন। হয়তো সামগ্রিক ভাবে পাপ-অন্যায় ধুয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি।’ সমাজতত্ত্ববিদ তাপস মাকরের বক্তব্য, ‘সোশিয়োলজিস্ট জর্জ হারবার্ট মিড বলেছিলেন, একজন মানুষের দু’টি সেল্ফ থাকে।

    একটি আই সেল্ফ, অন্যটি মি সেল্ফ। এই আই সেল্ফ হচ্ছে আমি যা চিন্তা করি। আর মি সেল্ফ হচ্ছে আমাকে নিয়ে লোকে যা চিন্তা করে। আমার মনে হচ্ছে এখানে অর্ণব দাম তাঁকে নিয়ে লোকজনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ধুয়ে ফেলতে বলেছেন।’

    বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বলেন, ‘আমার মতে, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা নয়, সমাজের দিক থেকে কথাটি বলতে চেয়েছেন তিনি। বর্ষা মানেই তো শুদ্ধ করার বিষয়। সব কিছু ধুয়ে-মুছে দিয়ে নতুনের সৃষ্টির মতো একটি সিম্বলিক রিপ্রেজ়েনটেশন রয়েছে বৃষ্টিতে। অর্ণব দাম ভীষণই বুদ্ধিমান ও চিন্তাশক্তির অধিকারী। আমার মনে হয় তাঁর বক্তব্যে সমাজের পরিবর্তন বা সমাজের পাপ ধুয়ে যাওয়ার অ্যাঙ্গেল রয়েছে।’
  • Link to this news (এই সময়)