আড়াই হাজার বছর আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পেই বদলায় গঙ্গার গতিপথ, গবেষণায় দাবি ডাচ বিশ্ববিদ্যালয়ের
বর্তমান | ১৯ জুলাই ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পে পরিবর্তন হয়েছিল গঙ্গানদীর গতিপথ। নেদারল্যান্ডের ওয়াহনিগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক এলিজাবেথ চেম্বারলেইনের গবেষণায় এমনই বিস্ময়কর দাবি করা হয়েছে। বিষয়টি যথেষ্ট আতঙ্কেরও। কারণ, গাঙ্গেয় অববাহিকায় অতীতে এরকম ভয়াবহ ভূমিকম্পের নিদর্শন থাকায় প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি এখনও এই অঞ্চলে বড়সড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে? গবেষণাপত্রে তেমন আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। নেচার প্রকাশনার ‘নেচার কমিউনিকেশনস’-এ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্রটি।
গাঙ্গেয় অববাহিকায় বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ রয়েছে। সব উপনদী, শাখানদী মিলিয়ে গঙ্গার মাধ্যমে যত জল প্রবাহিত হয়, পরিমাণের নিরিখে তা পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ। আগে রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন এবং আফ্রিকার কঙ্গো নদী। গঙ্গার নদীপ্রণালী এত জটিল এবং অনন্য বলেই তা বিশ্বের তাবড় বিশেষজ্ঞদের আগ্রহের ক্ষেত্র। চেম্বারলেইনও সেই টানেই ছুটে এসেছিলেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশের দিকে, পদ্মার দক্ষিণাংশে। আদতে পদ্মা গঙ্গারই প্রবাহ। গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি খুঁজতে এসে নাটকীয়ভাবেই ভূমিকম্পের স্বপক্ষে প্রমাণ পান তিনি। একদিন কাজ সেরে হোটেল ফেরার পথে রাস্তা মেরামতির জন্য কাটা একটি গর্তে মাটির একাধিক স্তর পর্যবেক্ষণ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হন তাঁরা।
কী ছিল গর্তের মাটিতে? দেখা গিয়েছে, কালো চটচটে কাদার মধ্যে থেকে উঠে এসেছে ফুট দশেক লম্বা বালির স্তম্ভ। একেবারে আগ্নেয়গিরির মতো নীচ থেকে উঠে এসেছে সেটি। এ ধরনের ঘটনা শুধুমাত্র ভূমিকম্পের ফলেই ঘটে থাকতে পারে। ঢাকা থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে স্যাটেলাইট ম্যাপ দিয়ে গঙ্গার পুরনো খাতের দীর্ঘপথও ঘুরে দেখেন তাঁরা। বালির স্তম্ভের চেয়ে অন্তত ৮৫ কিলোমিটার দূরে তাঁরা দেখেছেন, নদীখাতের বড় অংশেই রয়েছে কালো কাদামাটির স্তর। যে কোনও নদীখাতের ক্ষেত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে, ওই ‘বালি আগ্নেয়গিরি’ না দেখলে ভূমিকম্পের তত্ত্বটি তাঁদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হত না।
কিন্তু কতদিন আগে হয়েছিল ওই ভূমিকম্প, তা কীভাবে জানা গেল? যে কোনও পলি দীর্ঘদিন চাপা থাকলে তা অল্প পরিমাণে তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসে। পলি সেটিকে শক্তিরূপে সঞ্চয় করে রাখে। ‘ডার্ক রুমে’ সেই পলির নমুনা নিয়ে গিয়ে গবেষণা চালান চেম্বারলেইন এবং তাঁর দল। কতদিন আগে শেষবারের মতো সেই পলিখণ্ডগুলি সূর্যালোকের সংস্পর্শে এসেছিল, তা গাণিতিক পদ্ধতিতে বের করা হয়। তাতেই ২৫০০ বছর আগের বিষয়টি উঠে এসেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ডিএসটি-ইনস্পায়ার ফ্যাকাল্টি দীপ ঘোষ বলেন, ‘২৫০০ বছর আগে ওই অঞ্চলে তেমন জনবসতি হয়তো গড়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির অন্যতম। তাই এখন এ ধরনের ভূমিকম্প হলে ফল হবে ভয়াবহ। একটাই বাঁচোয়া, ওখানে ভূত্বকের নড়াচড়া খুব একটা সক্রিয় নয়। তবে আশপাশের সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটগুলির ক্রিয়াকলাপে এই এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’ তিনি মনে করছেন, যেহেতু ভূমিকম্প নিয়ে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়, তাই সতর্কতাই বাঁচার হাতিয়ার। যেখানে সেখানে বহুতল নির্মাণ বন্ধ করা, নদীখাত থেকে বালি তোলা, অবৈধ নির্মাণ প্রভৃতি অত্যাচার থেকে প্রকৃতিকে বাঁচানো এই সতর্কতার মধ্যেই পড়ে।