সব্যসাচী সরকার: মা ও ছেলের এক আশ্চর্য লড়াইয়ের কাহিনি। কিডনি প্রতিস্থাপন, দু’পায়ে অপারেশন, শেষে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে এক মেধাবী এখন পিএইচডি–র কাজে মগ্ন। তাঁর আত্মপ্রত্যয় এবং উদ্যমের পাশাপাশি সেই মেধাবীর মায়ের ভূমিকাকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন বহু মানুষ।
ছোটবেলা থেকে নানা লড়াই। এসেছে সাফল্য। মাত্র ৫ মাস বয়সে কিডনির সমস্যা দেখা দেয় খড়দার বাসিন্দা সুহেল সেনের। তার মা মহুয়া মজুমদার তখন দক্ষিণেশ্বরের একটি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। একমাত্র সন্তানের এই বিপদের কথা জানতে পেরে তিনি শুরু করলেন এক নাছোড় লড়াই। ১৪ বছর বয়সি সন্তানের জন্য নিজের কিডনি দান করলেন। তখন অ্যাডামাস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র সুহেল। মনের জোরে কিডনি প্রতিস্থাপনের দেড় মাসের মধ্যেই সুহেল ছুটল স্কুলে। তখন সে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া। আইসিএসই পরীক্ষায় সুহেল পায় ৮৮ শতাংশ। এর পর ব্যারাকপুরের ডগলাস মেমোরিয়াল স্কুল থেকে আইএসসি–তে ৮৪ শতাংশ। শরীরে সে অর্থে কোনও সমস্যা ছিল না। আর–পঁাচজনের মতোই স্বাভাবিক চলছিল জীবন। সুহেল ধীরে ধীরে পড়াশোনার জগতে এগিয়ে চলল। ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজে ভূগোলে অনার্স নিয়ে ভর্তি হল। চূড়ান্ত পরীক্ষায় পেল ৫৫ শতাংশ নম্বর।
কিন্তু কেউই জানতেন না, আরও বড় সমস্যা এগিয়ে আসছে। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় হঠাৎ দেখা যায়, তার দুটি পা অল্প বেঁকে যাচ্ছে। তারও চিকিৎসা হল কলকাতার একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালে। এর পর এমএসসি–তে ভূগোলে সুহেল পেলেন ৭৪.৭ শতাংশ নম্বর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করলেন জিআইএস রিমোট সেন্সিং বিষয়ে। নেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন সুহেল। এবং ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজে গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে দূরসঞ্চার শিক্ষায় তিনি পড়াতে শুরু করলেন।
এর মধ্যে পাঞ্জাবে লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি–র কাজ শুরু করে দিলেন সুহেল। এজন্য বার কয়েক তাঁকে পাঞ্জাবেও যেতে হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় স্টেরয়েড নেওয়ার জন্য তাঁর শরীরে অজান্তেই বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সার। জিভের একাংশে ধরা পড়ে সমস্যা। গত বছর নভেম্বর মাসে মা ও ছেলের শুরু হল লড়াইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়। জিভের একাংশ কেটে বাদ দিতে হল। সেখানে শরীরের একটি নির্দিষ্ট অংশ থেকে মাংস নিয়ে জোড়া দেওয়া হল। শুরু হল কেমো দেওয়া।
সুহেল কিন্তু অদম্য। এ সমস্ত যেন তাঁর কাছে কোনও সমস্যাই নয়। ৩২ বছরের জীবনে এত ওঠাপড়া গায়ে লাগতে দেননি তাঁর মা। পরস্পর পরস্পরকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সাহস দেওয়ায় যেন পরিপূরক ভূমিকায়। কথায় কথায় মহুয়াদেবী জানালেন, ‘বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও কলামিস্ট সুহেল শেঠের লেখা খুব ভাল লাগত। তাই ওর নাম রেখেছিলাম সুহেল।’ সুহেল বললেন, সান্দাকফু ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন। হিমাচল, গোয়া, কালিম্পং কখনও বন্ধুদের সঙ্গে, কখনও মায়ের সঙ্গে। সিন্থেসাইজার বাজাতেন এক সময়। এখন গবেষণার কাজে সময় দিতে হয়। তিনি নিজের ঘরে ল্যাপটপ খুলে কাজের জগতেই ডুবে থাকেন। মহুয়া মজুমদার বললেন, ‘আমাদের এই লড়াইয়ে বহু চিকিৎসক ও পাড়া–প্রতিবেশীদের কাছে পেয়েছি।’ আগামী ডিসেম্বরে সুহেলের আর এক দফা শারীরিক পরীক্ষা হবে। কিন্তু এ–সব তঁার কাছে তুচ্ছ। তিনি তো ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছেন। ঠিক তেমনই সন্তানকে বড় করার জন্য সব সময়ই সাহস জুগিয়েছেন তাঁর মা। এই লড়াইয়ে দু’জনে যেন যুগ্মজয়ী। মহুয়াদেবী বললেন, ‘আমাদের পাশে বরাবর থেকেছেন ডাঃ সুদীপা মুখার্জি, ডাঃ সৌমেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ডাঃ সৌরভ দত্ত, ডাঃ হর্ষ ধর, ডাঃ শিঞ্জিনী দাস। এঁরা না থাকলে আমি লড়াই করতে পারতাম না।’ সাহসী এই মায়ের প্রশ্ন, ‘আমি চাই যদি নিয়ম এ–রকম করা যায়, আমার পেনশনের অংশ আমার অবর্তমানে সুহেল পাবে, তা হলে আমি শান্তি পাব। এখন খুব চাইছি, ও একটা চাকরি পাক। তা হলেই আমার লড়াই সার্থক হবে।’