• শহীদ স্মরণে ২৭ জুলাইয়ের সূচপুর গণহত্যা দিবস, মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রতীক্ষায় বাসাপাড়ার শহীদ স্মরণ মঞ্চ
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২১ জুলাই ২০২৪
  • খায়রুল আনাম: সময়ের আশ্চর্য সমাপতনে বদলে যায় অনেক কিছু। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যা অতি সাধারণ বিষয় হয়ে থাকে। ২১ জুলাইয়ের কলকাতার ধর্মতলায় তৃণমূল কংগ্রেসের শহীদ স্মরণ দিবস। যা নিয়ে শাসক দলের নেতানেত্রীদের দৌড়ঝাঁপের বিরাম নেই। কোন জেলা থেকে দলের কত লোকজন আসবেন, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আর এর পাঁচদিন পরেই রয়েছে নানুরের সূচপুর গণহত্যা দিবস। এই দিনটিও শহীদ স্মরণ দিবস হিসেবে পালন করে থাকে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে ২৭ জুলাই সূচপুর গণহত্যা দিবসে শহীদ স্মরণে কোথাও যেন একটা শূন্যতা কাজ করে চলেছে। কেন এমনটা হচ্ছে? রাজনৈতিক দিক থেকে এর তেমন কোনও বিশ্লেষণ করা না হলেও, এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্ব নেওয়ার পরে একবারও ২৭ জুলাই সূচপুর গণহত্যা দিবসের শহীদ স্মরণে বাসাপাড়ায় না আসার কারণে একটা শূন্যতার পরিধি ক্রমশই যে দীর্ঘ হচ্ছে, তা অনিবার্যভাবেই সত্য।

    নানুরের থুপসাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসাপাড়া থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে নওয়ানগর?কড্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের সূচপুর গ্রাম। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই সকালে সূচপুর গ্রাম এলাকায় জমি চাষের বিবাদকে কেন্দ্র করে রাজ্যের তৎকালীন শাসক সিপিএমের জল্লাদ বাহিনী বাম শরিক আরএসপি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে আসা ১১ জন ক্ষেতমজুরকে সূচপুর গ্রামে তুলে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরের মধ্যে ভরে মধ্যযুগীয় বর্ব্বরতায় পিটিয়ে পিটিয়ে আর বর্শা ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করে পৈশাচিক উল্লাসে মাতে। হাড়হিম করা সিপিএম-এর সেই পৈশাচিক হত্যালীলা নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ব বিবেককে। সিপিএম এই পৈশাচিক হত্যালীলা যখন ঘটায়, তখন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী।

    আর বোলপুর লোকসভার অধীন এখানকার সাংসদ ছিলেন সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি তাঁরই নির্বাচন ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া এতবড় হত্যালীলা ঘটার পরেও এখানে পৌঁছনোর আগে দিল্লি থেকে চলে আসেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ওই ১১ টি মৃতদেহের ময়নাতদন্তের পরে তা নিয়ে এসে নামানো হয় থুপসাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসাপাড়া বাসস্ট্যাণ্ডে। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃতদেহগুলির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞাা করেন যে, তিনি যতদিন বাঁচবেন আর যেখানেই থাকুন না কেন, প্রতি বছর ২৭ জুলাই তিনি বাসাপাড়ায় সূচপুর গণহত্যা দিবসে শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে হাজির থাকবেন। সেই সঙ্গে তিনি ১১ জন শহীদের পরিবারের একজন করে ব্যক্তিকে রেলে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন। তিনি এই প্রতিশ্রুতি রাখলেও রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ২৭ জুলাই সূচপুর গণহত্যা দিবসের শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে আর আসেননি। অথচ এখানকার মানুষ চাইছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৭ জুলাই সূচপুর গণহত্যা দিবসের শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে আসুন। তাঁর ছবি মঞ্চে রেখেই এই দিনটি এখানে পালিত হয়ে আসছে।

    সূচপুর গণহত্যা মামলায় সিপিএম-এর যে ৪৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে শারীরিক কারণে মুক্তি দেওয়া হয় এবং কয়েকজন কারাবাসকালে মারা যান। বাকিরা এখনও কারাগারেই রয়েছেন। বাম আমলে সূচপুর গণহত্যা মামলা যখন সিউড়ি আদালতে চলছে, তখন এই মামলার দেখভাল করতে মামলার প্রতিটি দিনে সিউড়ি আদালতে হাজির থেকে দলীয় কর্মীদের মনোবল বাড়াতেন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা মুকুল রায়। এই মামলার মূল সাক্ষী পুরন্দরপুরের আব্দুল খালেককে বিরূপ সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সিপিএম নানাভাবে চাপ সৃষ্টি ও প্রলুব্ধ করলেও তিনি বিরূপ সাক্ষী না হওয়ার জন্যই এই মামলায় ৪৪ জন সিপিএম নেতা-কর্মীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় বলে দাবি করা হয়ে থাকে।

    অথচ পরবর্তীতে সেই আব্দুল খালেকই তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে ব্রাত্য হয়ে রয়ে গিয়েছেন। সিপিএমের ভয়কে উপেক্ষা করে সূচপুর গণহত্যা মামলাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার আরেক তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অনুব্রত মণ্ডল বর্তমানে দিল্লির তিহার জেলে। মুকুল রায় এক সময় সূচপুর গণহত্যা দিবসের শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে বলেওছিলেন, সূচপুর গণহত্যা মামলাকে বিলম্বিত করার কাজটা করেছিলেন সিপিএম সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। জাস্টিট ডিলে, জাস্টিট ডিনাই-এই কাজটি করেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনিও এখন আর নেই। কিন্তু রয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই দলীয় কর্মী-সমর্থকরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২৭ জুলাই দেখতে চাইছেন বাসাপাড়ায় সূচপুর গণহত্যা দিবসের শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের এই প্রত্যাশা একেবারেই অমূলক নয় বলেই মানেন সকলেই।

  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)