• ‘মাই লর্ড নয়, স্যর বলুন’, বার্তা শিবজ্ঞানমের
    এই সময় | ২১ জুলাই ২০২৪
  • ‘আমায় মাই লর্ড নয়, স্যর বলুন।’ কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের তরফে এই বার্তা গেল রাজ্যের সব জেলা আদালতের বিচারকদের কাছে। আর এর ফলে ব্রিটিশ আমলের ফৌজদারি আইন বদলে নতুন আইনের রূপরেখা তৈরির পরে ফের মাথাচাড়া দিল আরও একটি প্রশ্ন। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ‘মাই লর্ড’ বা ‘লর্ডশিপ’ সম্বোধনের ব্রিটিশ বা ফরাসি রীতি এখনও এ দেশে থাকা উচিত কি না।এই দুই শব্দবন্ধ ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের। দেশের শীর্ষ আদালতে এই দুই শব্দবন্ধ ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আবেদন নিয়ে জনস্বার্থ মামলাও হয়েছে। আবার বিভিন্ন সময়ে অনেক বিচারপতি স্বেচ্ছায় তাঁদের ‘স্যর’ সম্বোধন করার লিখিত বার্তাও দিয়েছেন। তবে বাস্তবে কোনও পরিবর্তন হয়নি।

    এই আবহে আইনজীবীদের একাংশের প্রশ্ন, বিচারপতিরা এমন গালভরা শব্দবন্ধ এজলাসে না শুনে সন্তুষ্ট হবেন তো? একই সঙ্গে আরও প্রশ্ন, আইনজীবী বা নিম্ন আদালতের বিচারকরা বিচারপতিদের ‘মাই লর্ডের’ বদলে ‘স্যর’ সম্বোধন করতে পারবেন তো? হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির তরফে ১৪ জুলাই রেজিস্ট্রার জেনারেল একটি ই-মেল পাঠিয়েছেন রাজ্যের সব আদালতের বিচারকদের। তাতে জানানো হয়েছে, এখন থেকে প্রশাসনিক বা বিচার বিভাগের যাবতীয় কাজে প্রধান বিচারপতিকে ‘স্যর’ সম্বোধন বাঞ্ছনীয়।

    ঠিক চার বছর আগে, ২০২০-র ১৬ জুলাই প্রায় একই মর্মে জেলা আদালতগুলিতে একই বার্তা পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি টিবিএন রাধাকৃষ্ণন। আইনজীবীদের প্রশ্ন, যদি সেই সময়ে তাঁর বার্তা কার্যকর হতো, তা হলে এখন আর বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে একই বার্তা নতুন করে দিতে হতো না। এ হেন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন বিচারব্যবস্থা সত্যিই বন্ধ করতে চায় কি না।

    কারণ অনেকেই মনে করেন, এই শব্দবন্ধ আসলে ঔপনিবেশিক যুগকে মনে করিয়ে দেওয়া। কেউ আবার মনে করেন, এই শব্দবন্ধ আসলে দাসত্বের ভাবনার প্রতিফলন। বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের ত্রুটি যে, আমরা আইনজীবীরা অভ্যেস বদল করতে পারছি না। আমাদেরই স্যর বলা অভ্যেস করতে হবে। ধীরে ধীরে সেটা শুনতেও অভ্যস্ত হয়ে যাবেন বিচারপতিরা।’

    কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত বলেন, ‘ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি না ‘মাই লর্ডের’ জায়গায় ‘স্যর’ বললে বিচারপতির সম্মানহানি হয়। আমরা দীর্ঘদিনের চলে আসা একটা প্রথা বহন করছি। একটু যদি সবাই চেষ্টা করি, তা হলেই এই শব্দবন্ধ আমরা ব্যবহার বন্ধ করতে পারি। আমার বিশ্বাস, ‘স্যর’ বললে কোনও বিচারপতিও তা নেতিবাচক হিসেবে দেখবেন না।’

    ২০১৪-এ সুপ্রিম কোর্টে এই ইস্যুতে এক মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এইচএল দাত্তু ও বিচারপতি এসএ বোবদের ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য ছিল, ‘মাই লর্ড’ বা ‘লর্ডশিপ’ না বলে ‘স্যর’ বললে কোনও আপত্তি নেই। তবে কোর্ট কোনও শব্দ চাপিয়ে দিতে পারে না। যদিও সুপ্রিম কোর্ট এটাও জানিয়ে দেয়, আপত্তি থাকলেও ওই সব শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করারও নির্দেশ দেবে না শীর্ষ আদালত।

    ফলে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদে ফের এই ইস্যুতে মুখ খুললেও বিতর্ক থামেনি। গত বছর নভেম্বরে শীর্ষ আদালতের বিচারপতি পিএস নরসিমা কিছুটা হালকা চালে এক বর্ষীয়ান আইনজীবীকে বলেছিলেন, ‘কতবার আপনি ‘মাই লর্ড’ বলবেন? আপনি যদি ‘মাই লর্ড’ বলা বন্ধ করেন, তা হলে আমি আপনাকে আমার বেতনের অর্ধেক দিয়ে দেবো।’

    ওই বিচারপতি যাই বলুন না কেন, প্রশ্ন উঠেছে, বাস্তবে সওয়াল-জবাবের মধ্যে ঘন ঘন ‘মাই লর্ড’, ‘লর্ডশিপ’-এর মতো শব্দবন্ধ শুনতে অভ্যস্ত কান এবং বলতে অভ্যস্থ মুখ, এই পরিবর্তন আদৌ মানতে পারবে তো?
  • Link to this news (এই সময়)