এই সময়: একসময়ে নিয়মিত ভালো রেজাল্ট করত হিন্দু ও হেয়ার স্কুলের পড়ুয়ারা। বাম জমানাতেই ওই দুই স্কুলের অবনমন শুরু হয়। এ বার তাদের দুরবস্থা নিয়ে নানা অভিযোগ উঠে এল কলকাতা হাইকোর্টে। সম্প্রতি একটি মামলায় ওই দুই স্কুলের হাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতি অমৃতা সিনহা।তাঁর বক্তব্য, ‘হিন্দু-হেয়ার স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক তো নেই-ই, এমনকী সেখানে সুইপার পর্যন্ত নেই। আমার কাছে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে। তার ভিত্তিতেই বলছি, ওখানে স্কুল সাফাইয়ের জন্য ছাত্র-অভিভাবকদের থেকে টাকা নেওয়া হয়।’ উল্লেখ্য, ওই মামলায় সরকারি আইনজীবী সুপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় এজলাসে দাবি করেন, ‘কলকাতা জুড়েই সরকারি স্কুলে এমন অবস্থা।’
এর প্রেক্ষিতেই বিচারপতি সিনহা ওই মন্তব্য করেন। দু’শো বছরেরও পুরোনো, কলকাতার প্রাচীন এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাঙালির আবেগের সঙ্গেও জড়িত। দিন কয়েক আগে শিক্ষক-বদলি সংক্রান্ত একটি মামলায় সরকারি স্কুলের দুরবস্থার প্রসঙ্গ উঠে আসে। জানা যায়, মামলাকারী প্রধান শিক্ষকের স্কুলে একজনও ছাত্র নেই। কলকাতারই একটি সরকারি স্কুলে এমন পরিস্থিতি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতি।
সরকারি আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তা হলে কি সরকার শিক্ষকদের বসে থাকার জন্য বেতন দিচ্ছে?’ এরই জবাবে হিন্দু-হেয়ারের প্রসঙ্গ টানেন সরকারি আইনজীবী। বিচারপতি সিনহা ওই দুই স্কুল সম্পর্কে মন্তব্যের পাশাপাশি বলেন, ‘কেন মা-বাবারা এমন স্কুলে সন্তানকে পাঠাবেন? স্কুলগুলিকে আরও উন্নত করার দিকে সরকারের মনোনিবেশ করা দরকার।’
কী অবস্থা হিন্দু-হেয়ারের? কলেজ স্ট্রিটে মুখোমুখি এই দুই স্কুলের মধ্যে হেয়ারে ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত হাজারের কাছাকাছি ছাত্র। তবে মাধ্যমিক সেকশনে পড়ুয়া থাকলেও উচ্চ মাধ্যমিক সেকশন পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে। ইলেভেনে সায়েন্সে ১০০টি সিটের মধ্যে পড়ুয়া আছে জনা ২০। আর্টসে ৩০টি সিট, পড়ুয়া ১৫-ও পেরোয়নি। কমার্সে ৬০টি সিট, পড়ুয়া-সংখ্যা ৩০-৩৫ এর মধ্যে।
প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘একাদশে সাবজেক্ট হিসেবে কম্পিউটার থাকলেও কোনও শিক্ষক নেই। তাই আমরা ছাত্র পাচ্ছি না। সুইপার তিন জন থাকার কথা, একজন আছেন। অন্য একজনকে সমগ্র শিক্ষা প্রকল্পের সহায়তায় আংশিক সময়ের জন্য নেওয়া হয়েছে।’ এতকিছুর পরেও কোনও ছাত্রের থেকে টাকা নেওয়া হয় না বলে জানান তিনি।
স্কুলের বায়োলজির শিক্ষক তথা সরকারপন্থী শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘৬০ জন পূর্ণ সময়ের শিক্ষক পদ থাকলেও আছেন ৩৮-৪০ জন। মর্নিং সেকশনে কোনও দারোয়ান নেই। বহু শিক্ষক অবসর নিলেও কেউ জয়েন করেননি।’ হিন্দু স্কুলের সিনিয়র শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, মর্নিং ও ডে সেকশন মিলিয়ে ছাত্র-সংখ্যা ১,৩১৮। মর্নিংয়ে চারজন পূর্ণ সময়ের শিক্ষক আছেন।
এঁদের একজন আগামী মাসে অবসর নেবেন। ডে সেকশনে পোস্ট ৪৮-এর আশপাশে, আছেন ২৬ জন। দু’জনের জায়গায় এখন একজন সুইপার রয়েছেন, বাকি কাজ আংশিক সময়ের একজনকে দিয়ে করানো হয়। স্কুলে ইংরেজিতে মাত্র একজন শিক্ষক, থাকার কথা ৫ জনের। পলিটিক্যাল সায়েন্সেও কোনও শিক্ষক নেই বলে খবর।
তবে শিক্ষকদের একাংশের দাবি, প্রয়োজনে তাঁরা চাঁদা তোলেন, কিন্তু কোনও পড়ুয়ার থেকে স্কুল সাফাইয়ের জন্য টাকা নেওয়া হয় না। হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভ্রজিৎ দত্তর বক্তব্য, ‘আমরা কোনও ছাত্রের থেকেই সাফাইয়ের জন্য টাকা তুলি না। তা ছাড়া আমাদের স্কুল অপরিষ্কার নয়।’
সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তরফে সৌগত বসুর বক্তব্য, ‘কেবল হিন্দু-হেয়ার নয়, সামগ্রিক ভাবে সব স্কুলেই শিক্ষক থেকে গ্রুপ ডি কর্মীর অভাব আছে। ২০১৭-র পর পিএসসি কোনও শিক্ষক নিয়োগ করেনি। স্কুল-শৌচালয়গুলির অবস্থা রাজ্য জুড়েই করুণ।’ চেষ্টা করেও শিক্ষা দপ্তরের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে দপ্তরের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, সব অভিযোগই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।