এই সময়: উত্তপ্ত বাংলাদেশ থেকে একরকম প্রাণ হাতে করে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসে পৌঁছচ্ছেন বহু মানুষ। তাঁদের একটা বড় অংশই পড়ুয়া। এর মধ্যে ভারতীয় নাগরিক যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন নেপাল-ভুটান ও মালদ্বীপের বাসিন্দারাও। কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধা, মালদার মহদিপুর কিংবা দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত, সর্বত্র ছবিটা একই রকম।এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, 'সমস্যাদীর্ণ বাংলাদেশ থেকে শয়ে শয়ে পড়ুয়া এবং অন্যরা ফিরে আসছেন। যাঁরা ফিরছেন তাঁদের সাহায্য করার জন্য রাজ্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি। হিলি সীমান্তে এ দিন প্রায় ৩০০ জন পড়ুয়া এসে পৌঁছন। তাঁরা নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫ জনের সাহায্য প্রয়োজন হয়েছিল। আমরা সাহায্য করেছি।'
এ দিন হিলি দিয়ে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁদের মধ্যে ভারতীয় যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন নেপালের পড়ুয়ারাও। বাংলাদেশ প্রশাসন পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে তাঁদের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশের মেডিক্যাল পড়ুয়া মুর্শিদাবাদের আব্দুল জাফর বলেন, 'বাংলাদেশের অবস্থা খুব ভয়ঙ্কর। আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। নেপালে পড়ুয়ারাও আমাদের সঙ্গে আছেন।'
কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে রবিবার ভারতে এসেছেন ৫৫০ জন পড়ুয়া। এর মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ৩৩৮ জন। এ ছাড়াও নেপালের ১৮৬ জন, ভুটানের ২৫ জন ও মালদ্বীপের একজন নাগরিক রয়েছেন। বাংলাদেশের রংপুর ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এই পড়ুয়ারা ফিরেছেন। এ দিন চিকিৎসার প্রয়োজনে ২৮ জন বাংলাদেশের নাগরিকও ভারতে এসেছেন এই সীমান্ত দিয়েই।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী খুশি সেনহারিয়া রবিবার চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে রওনা হন তাঁর বাড়ি গুজরাটের উদ্দেশে। বলেন, 'গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশে আছি। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে মেডিক্যাল কলেজ ও ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এ বার বাড়ি ফেরার পালা।'
রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র জম্মু কাশ্মীরের বাসিন্দা মুজাহার শেখ বলেন, 'বাংলাদেশে অশান্তি ও হিংসার খবর জানার পর থেকে পরিবার দুশ্চিন্তায় ছিল। সীমান্তে এসে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পেরেছি। এ বার ফ্লাইট ধরে সোজা বাড়ি ফিরব।' বাংলাদেশ থেকে আসা পড়ুয়াদের জন্য কোচবিহার পুলিশ ক্যাম্প খুলেছে। কে কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন, গাইড তাঁরা।
কোচবিহারের পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য বলেন, 'পড়ুয়ারা সুষ্ঠু ভাবে বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন। সকলকে সহযোগিতার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন আছে চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তে ইমিগ্রেশন চেক পোস্টে৷' উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমও চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত থেকে স্পেশ্যাল ১০টি বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী বেশ কিছুদিন সেখান থেকে শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড ও বাগডোগরা বিমানবন্দর পর্যন্ত এই বাসগুলি যাতায়াত করবে।
রবিবারই বাংলাদেশের সোনা মসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে মালদার মহদিপুর স্থলবন্দরে পৌঁছন ২৭৪ জন ছাত্রছাত্রী। সকলেই ডাক্তারি পড়ুয়া। বেশির ভাগই জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা। ছিলেন দিল্লি, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও অসমের পড়ুয়ারাও। নিজের দেশে ঢুকে স্বস্তি মিললেও বাড়িতে কী ভাবে পৌঁছবেন, সেই ভাবনাতেই অস্থির হয়ে ওঠেন তাঁরা। মালদার মহদিপুর অন্য সময় ফাঁকা থাকলেও রবিবার দুপুরে ছিল ভিড়ে ঠাসা। সাধারণ যাত্রী কয়েক জন রয়েছেন বটে, তবে বেশির ভাগই বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া।
শ্রীনগরের রায়হান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, একই এলাকার শর্মিনা পড়ছেন তৃতীয় বর্ষে। অসমের গোঁসাইগাঁওয়ের মেয়ে শামিমা নাসরিনও পড়েন তৃতীয় বর্ষে। জানালেন, তাঁদের ক্যাম্পাসটা একটু ভিতর দিকে হওয়ায় গোলমালের আঁচ তেমন লাগেনি। তবে ১৭ জুলাই কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে কাউকে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরোতে দেওয়া হয়নি। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। যাতায়াত ব্যবস্থাও বন্ধ।
বিদেশি ছাত্রদের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করে দেয়। ভাড়া অবশ্য ছাত্রছাত্রীদের গুনতে হয়েছে। শনিবার রাত ২টো নাগাদ ভারতীয় পড়ুয়াদের নিয়ে তাঁদের কলেজ থেকে ৫টা বাস রওনা হয়। সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স এবং সামনে-পিছনে বাংলাদেশ সেনার এসকর্ট। পথে সমস্ত শহর এবং গোলমালের জায়গাগুলোকে এড়িয়ে ঘুরপথ দিয়ে তাঁদের কনভয় এ দিন বেলা বারোটা নাগাদ সীমান্তে এসে পৌঁছয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। এ পারে পৌঁছেই সবাই তাই বাড়ির সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এর পরেই মাথায় ঢোকে বাড়িতে পৌঁছবেন কী ভাবে। অসমের শামিমা অন্য সময় চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকে কোচবিহার থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি যান। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিরাপদ এলাকা হিসেবে এই পথ দিয়ে নিয়ে আসায় তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, কোন ট্রেনে কীভাবে ফিরতে পারবেন তার খোঁজ নিতে। কাশ্মীরের ছেলেমেয়েদের দেখা গেল, কলকাতা থেকে বিমানের টিকিটের খোঁজে অনলাইনে ডুবে যেতে।
একজন প্রচুর দাম দিয়ে ভোর পাঁচটার ফ্লাইটের টিকিট কেটে উল্লাসে ফেটে পড়লেন। কিন্তু তাঁর সেই উল্লাস মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল, যখন জানলেন মালদা থেকে কলকাতা প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার এবং ফ্লাইটের টাইমে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব। রাত জেগে লম্বা বাস জার্নি করে সীমান্তে পৌঁছনো পড়ুয়াদের জন্য বিএসএফ জওয়ানরা মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেন। ছাত্রছাত্রীদের বিশ্রামের জন্য নিজেদের ক্যাম্প ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি আলাদা টেন্টও তৈরি করে দেন তাঁরা।
সীমান্ত থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের মালদা শহরে বাসস্ট্যান্ড ও রেল স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করলেন নিজেদের গাড়িতে। জেলাশাসক নীতিন সিংঘানিয়া বলেন, 'জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেই বিএসএফ-এর সঙ্গে বৈঠক করে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। এক জন অতিরিক্ত জেলাশাসককে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশ ফেরত ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি ফেরার ব্যাপারে সম্ভব মতো সহযোগিতা করবার জন্য।'