এই সময়: ৪৮০ বর্গফুটের ছোট্ট দু’কামরার ফ্ল্যাট। সেখানেই থাকেন ওঁরা পাঁচ জন। ভোরের আলো ফুটতে না-ফুটতেই রাজকিশোর রজক বেরিয়ে পড়েন বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটি অভিজাত বহুতল আবাসনের উদ্দেশে। সকাল থেকে রাত, পার্কিং লটের একাংশেই দিন কাটে তাঁর। একের পর এক জামাকাপড় আয়রন (ইস্ত্রি) করে ক্লান্ত দিনের শেষে ফিরে যাওয়া ওই ৪৮০ বর্গফুটেই।তা-ও নিজের কোনও ঘর নেই, হলঘরেই শুয়ে পড়েন বিছানা পেতে। গত ২৫ বছর ধরে কসবার বাসিন্দা রাজকিশোরের এটাই রুটিন। দিনরাত তাঁর আয়রন গরম করার উনুন জ্বলছেই। রাজকিশোর সেটা নিভতে দিচ্ছেন না। তিনি জানেন, ওই আগুন একবার নিভে গেলে তাঁর ছেলেটার আর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়া হতো না।
মেয়েটাও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আর ব্যাঙ্ক বা সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে না। রাজকিশোর এই শহরের ভিড়ে মিশে থাকা সেই শ্রমজীবী, যাঁকে আলাদা করে চোখে পড়ে না। নিজে ম্যাট্রিক পাশ। যে বাবুদের জামাকাপড় তিনি ইস্ত্রি করতেন, তাঁদের অনেকেই সিএ। বাড়ি, গাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালান্সে ভরা এক সুন্দর নিরাপদ জীবন। ম্যাট্রিক পাশ রাজকিশোরের কিছুই নেই প্রায়।
কিন্তু রয়েছে দুই মেধাবী সন্তান। ছেলে বড়, মেয়ে ছোট। তখন তাঁরা বিহারে মুজফ্ফরপুরে দেশের বাড়িতে থাকতেন। বছরে এক-আধবার বাড়ি ফিরে ছেলে আমনকুমারকে বলে যেতেন, ‘সিএ হও। সেই ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করো।’ আমন তখন ক্লাস সেভেন কী এইট। সিএ-র মানেও জানত না। বাবার কথা রাখার জন্য নানা অভাবের মধ্যেও পড়াশোনা মন দিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন।
২০১৯ সালে ক্লাস টুয়েলভ পাশের পর মা আর বোনকে নিয়ে আমন চলে আসেন কলকাতায় কসবার ওই চার দেওয়ালে। তারপর পাঁচ বছর আমন শুধু পড়েই গিয়েছেন। কোনও দিকে নজর দেননি, ঘুরতে-বেড়াতেও যাননি। সম্প্রতি আমন সিএ পাশ করে বাবা এবং মা অঞ্জুদেবীর মুখ রেখেছেন। ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছে একাধিক মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরির অফার।
পরিশ্রমের ফল পেলেন? আমন অবশ্য বলছেন, ‘আমি আর কী মেহনত করেছি, যা করেছেন সেটা তো বাবা-ই। গায়ে ধুম জ্বর নিয়েও বাবা আয়রন গরম করে গিয়েছেন, কত দিন মার একটা নতুন শাড়ি কেনা হয়নি। কিন্তু কোনও অভিযোগ না করে বাবা-মা আমাকে কেবল পড়ে যেতে বলেছেন। ওঁদের মেহনতেরই ফল পেয়েছি আমি।’
ম্যাট্রিক পাশ করা রাজকিশোর স্কুলের গণ্ডি পেরনোর আগেই তিন পুরুষের কাজে নাম লেখান। ইচ্ছে থাকলেও আর পড়তে পারেননি। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তাঁর। রাজকিশোরের যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর স্ত্রী স্কুল পাশ করেছেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে বিহারেরই একটি কলেজ থেকে হোম সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। গ্র্যাজুয়েশনও পাশ করেন অঞ্জু। তারপর ছেলে আমন আর মেয়ে অনামিকার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
রাজকিশোরের কথায়, ‘আমি ছেলে আর মেয়েকে কখনও আলাদা চোখে দেখিনি। অনেকে শুধু ছেলেকে পড়ায়, আর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়। ছেলেকে যেমন পড়িয়েছি, মেয়েকেও বলেছি যত দূর পড়তে চাও পড়ো।’ আমনের বোনও সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। আরও পড়ার ইচ্ছে আছে। আর চাকরি পেয়েই অমন বাবা-মা-বোন-দাদাজিকে নিয়ে পুরী বেড়াতেন যাবেন বলে ইচ্ছেপ্রকাশ করছেন। কারণ বাবা-মা যে বহুবহু বছর হয়ে গেল কোথাও বেড়াতেও যাননি!