এই সময়: এ বারের লোকসভা ভোটে জিতে টানা তৃতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বিজেপির। তাই এনডিএ-র দুই মূল শরিক নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর দলকে কোন জাদুমন্ত্রে বশ করবেন মোদী-অমিত শাহরা— সে দিকে নজর ছিল সব পক্ষেরই। শেষমেশ বিহারকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা না-দিলেও যে ভাবে বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বাজেটে ঢেলে বরাদ্দ করা হলো কেন্দ্রীয় বাজেটে, তাকে ‘গদি রক্ষার’ বাজেট বলেই সার্বিক ভাবে আক্রমণ শানাল বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ ব্লক।নীতীশ ও চন্দ্রবাবুর মন রাখতে কেন অন্য রাজ্যগুলিকে বঞ্চিত করা হলো, সম্মিলিত ভাবে সে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদবের মতো বিরোধী নেতৃত্ব। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন খোলাখুলিই বলেছেন, বিহার বা অন্ধ্রপ্রদেশকে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু তা বলে পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্য রাজ্যগুলিকে বঞ্চিত করা হবে কেন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আবার রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কয়েক দিন আগের স্লোগান— ‘জো হমারে সাথ, হম উনকে সাথ’ তুলে ধরেই কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছেন কেন্দ্রের সরকারপক্ষকে।
তাঁর বক্তব্য, এই বাজেট থেকেই পরিষ্কার, সরকার বাঁচাতেই এই বাজেট করা হয়েছে। আজ, বুধবার লোকসভায় বাজেট বিতর্কে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ তুলে সরব হতে চলেছেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। তৃণমূলের তরফে বাজেট বিতর্কে প্রথম বক্তাই থাকবেন অভিষেক। এই বাজেটের বিরুদ্ধে আজ সংসদের বাইরে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের সাংসদরা বিক্ষোভ দেখাবেন।
পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীতি আয়োগের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাকে বঞ্চনার অভিযোগ তুলবেন বলেও এদিন জানিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। নির্মলা সীতারামনের বাজেট দেখে এদিন বিধানসভায় নিজের কক্ষে মমতা বলেন, ‘অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহারকে টাকা দিয়েছে— আমার কোনও আপত্তি নেই। ওরাও আমাদের দেশের অংশ। তবে একজনকে দিতে গিয়ে আর একজনকে বৈষম্য করা যায় না। এটা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বাজেট। দিশাহীন, গরিব বিরোধী, জনবিরোধী বাজেট। কোনও ভিশন নেই। শুধু রাজনৈতিক মিশন রয়েছে। আমি কোনও আলো দেখতে পাচ্ছি না, শুধু অন্ধকার, অন্ধকার আর অন্ধকার।’
এই পরিস্থিতির জন্য এনডিএ-র কিছু দলকে দায়ী করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘সরকারকে একতরফা দোষ তো দেবো না। যে পার্টিগুলো আছে, তারা তো গুরুত্বপূর্ণ। তারা এটা অ্যাকসেপ্ট করেছে। কেন করেছে?’ অন্ধ্র-বিহারের বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে অভিষেকের বক্তব্য, ‘শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, জো হমারে সাথ, হাম উনকে সাথ। এ দিন সেটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। সরকার বাঁচাতে এরা বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দিয়েছে। অন্য কোনও রাজ্যের সঙ্গে আমাদের সমস্যা নেই, কিন্তু কেন বাংলাকে বঞ্চনা করা হবে?’
কী ভাবে এই বাজেটে বাংলাকে বঞ্চিত করা হয়েছে?
মমতার কথায়, ‘একশো দিনের কাজের টাকা নিয়ে কোনও হুঁশ নেই। ওরা বলেছে, তিন কোটি বাড়ি দেওয়া হবে? কাকে দেওয়া হবে? বাংলার আশপাশে সব রাজ্যকে ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের টাকা দেওয়া হলো। একমাত্র রাজ্য বাংলা কী অপরাধ করল? আমাদের ১ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আছে। এক পয়সাও দেওয়া হয়নি।’
এনডিএ-র শরিকদের মন জয় করার পাশাপাশি ‘ক্রোনি ক্যাপিট্যালিস্ট’দের তুষ্ট করার লক্ষ্যেই বাজেট হয়েছে বলে মনে করছেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। এক্স হ্যান্ডলে নির্মলার বাজেটকে কটাক্ষ করে রাহুল বলেছেন, ‘জোট শরিকদের তোষণ করা হয়েছে। অন্য রাজ্যগুলির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে এই শরিকদের ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আমজনতাকে কোনও রিলিফ না দিয়ে ‘এ-এ’কে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।’
রাহুল ‘এ-এ’ বলে আম্বানি-আদানিদের ইঙ্গিত করেছেন বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের মত। সার্বিক ভাবে বাজেটের সমালোচনা করলেও রাহুল গান্ধী, পি চিদম্বরম-সহ কংগ্রেস নেতৃত্ব এই বাজেটের মধ্যে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারেরই কিছু প্রতিশ্রুতি অনুকরণ করা হয়েছে বলেও খোঁচা দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পাঠ শেষ হওয়ার পরেই অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে সমাজবাদী পার্টি সুপ্রিমো অখিলেশ যাদব বলেন, ‘চেয়ার রক্ষা করতে এই বাজেট তৈরি করা হয়েছে। কৃষকদের আয় না বাড়লে, যুবকদের পাকা চাকরির ব্যবস্থা না-হলে বাজেটে কোনও লাভ নেই।’
‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের আর এক শরিক, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ‘সুপার-রিচ’দের উপর কোনও কর বসানোর চেষ্টা করা হলো না বাজেটে। সাধারণ মানুষের উপরে যে পরোক্ষ করের বোঝা রয়েছে, তাও কমানো হলো না। এর অর্থ, ‘সুপার-রিচ’দের আরও সম্পদ তৈরির সুযোগ দেওয়া হলো।’ ওডিশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক আবার প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কেন উৎকলের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হলো না?’
সদ্য হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে ওডিশায় এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। একদা মোদী সরকারের ‘বন্ধু’ নবীনের প্রশ্ন, ‘সেই প্রতিশ্রুতি কেন রক্ষা করা হলো না?’ আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে এ প্রশ্নও তুলেছেন— গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় এবং ওডিশা— এই যে চার রাজ্য থেকে ৮৭টির মধ্যে লোকসভা ভোটে ৮৪টি সিট পেয়েছে বিজেপি, দুই শরিককে তুষ্ট করতে গিয়ে সেই রাজ্যগুলির কথাও ভাবা হলো না কেন?
তবে এত প্রতিশ্রুতির পরেও কি নীতীশ-চন্দ্রবাবুর কাছ থেকে পাঁচ বছর তখতে থাকার গ্যারান্টি পেলেন নরেন্দ্র মোদী? কারণ, নীতীশের দলের ১২ জন, চন্দ্রবাবুর দলের ১৬ জন সাংসদই এনডিএ সরকারের প্রাণভোমরা। প্রশ্ন অনেক। উত্তরের জন্য আগামীর অপেক্ষায় শাসক-বিরোধী সবাই।