নিজস্ব প্রতিনিধি, ভাতার ও সংবাদদাতা, কাটোয়া: ভাতার ও মঙ্গলকোটের সাতটি গ্রামে চোর বা ডাকাত ঢোকার সাহস পায় না। গ্রাম পাহারা দেয় ঝাংলাই। বড়পোষলা, ছোটপোষলা, মশারু, ময়দান গ্রামে রান্নাঘর থেকে উঠান, সর্বত্র বিচরণ তাদের। বাইরের কেউ একঝলকে দেখলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে অবশ্য তা ‘ঘরের মা’। ঝাংলাই হল বিষধর প্রজাতির কেউটে সাপ। বড় ফণা রয়েছে। লেজে পা পড়লে দংশনও করে। কিন্তু ছোবল খাওয়ার পরও কেউ ‘ছবি’ হয় না। গ্রামের পুকুরে মাটি লাগালেই প্রাণে বেঁচে যান। গ্রামের বাসিন্দাদের এই সাপ তেমন দংশন করে না। কিন্তু বাইরের কারও কাছে তা ভয়ানক। এলাকার সকলেই জানেন সকাল থেকে রাত সবসময় ঝাংলাই গ্রামে ঘুরে বেড়ান। তাই চোর বা ডাকাতরা গ্রামে ঢোকার সাহস দেখায় না।
বড়পোষলা গ্রামের বাসিন্দা দিব্যেন্দু দত্ত বলেন, গ্রামে কোনওদিন চুরি হয়েছে বলে শুনিনি। ঝাংলাই মা সকলকে রক্ষা করেন। আর এক বাসিন্দা হরিহর চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর গুরুপূর্ণিমার দিন ঝাংলাই মায়ের পুজো হয়। এলাকার সাতটি গ্রামে ধুমধাম করে পুজো হয়। সোমবারও পুজো চলে। এই প্রজাতির সাপের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে আসছে। এই সাপেরও বিষ রয়েছে। তবে তা অন্যান্য কেউটের তুলায় অনেক কম। কিন্তু কী কারণে শুধু এই এলাকাতেই এধরনের সাপ দেখা যায় তার রহস্য উন্মোচন হয়নি। বাসিন্দাদের বিশ্বাস ওই সাপই হল আসলে মা ঝঙ্কেশ্বরী বা ঝাংলাই। মশারু গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণা সাঁই বলেন, আমাকে পায়ে দংশন করেছিল। আমি এখনও দিব্যি বেঁচে আছি। এলাকার বাসিন্দা অসিত রায়, স্বর্ণালী রায় বলেন, গ্রামজুড়ে বহু বছর ধরেই সাপের সঙ্গে সহাবস্থান করি। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় বিষধর সাপ। আমাদের কারও কোনওদিন ক্ষতি করেনি। তবে আমাদের কাছে উনি মা ঝঙ্কেশ্বরী। আমরা ভক্তিভরে মায়ের পুজো দিই। স্থানীয়রা বলেন, গ্রামের মন্দিরে পুরোহিত জ্যান্ত কেউটে সাপের লেজ ধরেই পুজো করেন। পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সেই কেউটের মাথায় দুধ, গঙ্গাজল ঢালেন। পুরোহিত নিজের হাতে সিঁদুর মাখিয়ে দেন কেউটের মাথায়। তখন মাঝেমধ্যে সাপটি ফণা তুললেও কেউই ভয় পান না। গ্রামে নতুন কোনও মেয়ে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে এলে তাঁরও নাকি ভয় দূর হয়ে যায়। তবে কথিত আছে, নতুন বউদের উপর নাকি একবছর মা ঝঙ্কেশ্বরী অভিমান করে থাকেন। তারপর সব ঠিক হয়ে যায়। ভয় দূর হয়ে যায়। মশারু গ্রামের পুরোহিত মুরলীমোহন চক্রবর্তী প্রথম স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তারপর তাঁর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা হয় মা ঝঙ্কেশ্বরী। অতীতে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের বহু গবেষক ঘুরে গিয়েছেন। এখনও কেউ কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। কেন এই গ্রামগুলিতে সাপের কামড়ে মৃত্যু নেই তারও কোনও উত্তর নেই এখনও। সাপ ও মানুষ একসঙ্গে বসবাস করলেও মশারু গ্রামে সাপের বাসস্থান কমে আসছে বলে আক্ষেপ করছেন বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, এখন গ্রামে খড়ের পালুইয়ের সংখ্যা কমে আসছে। মাটির বাড়ির বদলে পাকা ছাদ উঠছে। তাই সাপের বাসস্থান ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে।