প্রশান্ত দাস: মঙ্গলে পেশ করা বাজেট নিয়ে বুধে লোকসভায় প্রতিবাদে সরব হবেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দোপাধ্যায়, এই বিষয়টি পূর্বে তিনি নিজেই স্পষ্ট করেছিলেন। যেমন কথা তেমন কাজ, বুধবার লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে বাজেট সংক্রান্ত আলোচনার সূচনা করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই। হয়ে ওঠেন ‘আক্রমণাত্মক’। একদিকে যেমন অভিষেক কড়া ভাষায় আক্রমণ শানান এনডিএ সরকারকে, তেমনি ইংরেজি শব্দ ‘বাজেট’ এর প্রত্যেক অক্ষরের ব্যাঙ্গাত্মক প্রতিনিধি শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেন। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি বলেন, এই বাজেট “দু’জনের পরিকল্পনায় গঠিত এবং দু’জনের জন্য বাস্তবায়িত।” প্রায় ৫৩ মিনিটের বক্তব্যে দফায় দফায় অভিষেক তথা তৃণমূলের সাথে বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে বিজেপির। ২০১৬-১৭ এর বাজেট নিয়েও এদিন কটাক্ষের সুর চড়ান অভিষেক, নোট বাতিলের প্রসঙ্গ টানেন। এ প্রসঙ্গে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা অভিষেককে বাধা দিয়ে বলেন, “বর্তমান বাজেট নিয়ে কথা বলুন।” অভিষেকের পাল্টা জবাব, “যখন কেউ ষাট বছর আগের জওহরলাল নেহেরুর কথা বলবেন, অন্য নেতৃত্বদের কথা বলবেন তখন আপনি চুপ থাকবেন! আমি ৫ বছর আগের নোট বাতিলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই আপনি বলবেন বর্তমানের কথা বলতে। যখন বিপ্লব দেব ৫০ বছর আগের জরুরি অবস্থার কথা বলছিলেন, তখন আপনি চুপ ছিলেন! এই পক্ষপাত চলতে পারেনা।” এদিনের বক্তব্য শেষে অভিষেকের স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, “মোদী সরকার এক নড়বড়ে জোট নিয়ে চলছে। আপনাদের বলব, সিট বেল্ট বেঁধে নিন, আবহাওয়া খারাপ হতে চলেছে।”
বক্তব্যের শুরুতেই তৃণমূল সেনাপতি বলেন, “জোটের অর্থ আমরা জানতাম সহযোগিতা। কিন্তু বাজেট পেশের পর আমরা দেখলাম জোটের অর্থ তুষ্টিকরণ।” অভিষেক আরও বলেন, “সময় বদলেছে। গণতন্ত্রে বিজেপি জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, কিন্তু তাঁদের ভাবনাচিন্তার পরিবর্তন হয়নি। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী প্রত্যেকেই একই রয়েছেন। বদল ঘটেছে কেবল চিয়ার লিডারের অর্থাৎ বিজেপির বক্তব্যের সমর্থনে বেঞ্চ বাজানোর মানুষে ঘাটতি হয়েছে কারণ জনসাধারণ তাঁদের গণতন্ত্রের মন্দিরে যাওয়ার সেই ক্ষমতাটা দেননি।” বিজেপি প্রত্যেক যোজনার নামের সংক্ষিপ্ত রূপ বের করেছে। প্রায় ১১০টির মতো এমন সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। অভিষেকের ভাষায়, “আমি তাঁদের বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীকে সেই ভাষাতেই জবাব দিতে চাই, যেটা তাঁরা বোঝেন।”
এরপর প্রথমেই তিনি ইংরেজি শব্দ ‘বাজেট’ এর ইংরাজি ‘বি’ শব্দটির অর্থ বলেন, ‘বিট্রেয়াল’ অর্থাৎ ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। অভিষেকের অভিযোগ, মোদী সরকার নাগরিক, গৃহবধু, দিনমজুর ও কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এক বছরে ভেজ থালির দাম ৮ শতাংশ বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম ৪৩ শতাংশ, টমাটোর দাম ৪১ শতাংশ, আলুর দাম ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। এলপিজি গ্যাসের দাম বেড়ে ২০২৩-এ হয়েছিল ১১০০ টাকা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৈনিক আয় ৩o৮ টাকার কম। এদিকে মানুষের সঞ্চয় ৫০ বছরে সবথেকে কম অবস্থায় পৌঁছেছে। এরপরই তাঁর সংযোজন, “বিজেপি সবকা সাথ সবকা বিকাশ-এর মন্ত্র ভুলে ‘যো হামারে সাথ, হাম উনকে সাথ’ মন্ত্রে চলছে। লোকসভা, রাজ্যসভায় বিজেপির একজনও মুসলিম সদস্য নেই। সংসদে বৈচিত্রের অভাবে, সংসদে সংখ্যালঘুদের আকাঙ্খা পূরণ হচ্ছে না। সরকারি নীতি অসাম্যকে বাহবা দিচ্ছে। তাই লোকসভা নির্বাচনে মোদী সরকারকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।” উত্তরপ্রদেশে, রাজস্থানে সবচেয়ে বেশি দলিত আক্রমণ হয়, সে বিষয়ে বিজেপি নেতৃত্বরা কিছু বলবেন?”
বাজেটের দ্বিতীয় অক্ষর ‘ইউ’। এটি আনএম্প্লয়মেন্ট বা বেকারত্বকে চিহ্নিত করে। অভিষেক বলেন, “গত জুন মাসে আমাদের দেশে বেকারত্বের হার পৌঁছেছিল ৯.২ শতাংশে। কর্মসংস্থানের ৫টি প্রকল্প এবং ৪ কোটি ১০ লক্ষ যুবকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অর্থমন্ত্রী ২ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এর আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতিবছর ২ কোটি চাকরি দেওয়ার। সেই লক্ষ্য পূরণের ধারে কাছে তারা নেই। এখন তারা অবাস্তব লক্ষ্য স্থির করছে। দেশের যুব সম্প্রদায় বিজেপির ফাঁপা প্রতিশ্রুতি, ৯০ মিনিটের লম্বা বাজেট বক্তৃতা শুনতে চায় না। তারা চাকরি চায়। শহুরে মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২২.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও স্লোগান দিয়েছে বিজেপি। কিন্তু, ‘বেটি কো নৌকরি দিলাও’ বলতে ভুলে গেছে! অন্যদিকে, বাংলায় কন্যাশ্রী প্রকল্প ৮৫ লক্ষ মেয়ের জীবনে উন্নতি ঘটিয়েছে। যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জও। লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প ২ কোটি ২০ লক্ষ মহিলাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, একে জাতীয় মডেলে পরিণত করুন।” যুবরাজের মতে, পশ্চিমবঙ্গ, তেলঙ্গানা এবং কর্নাটক সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছে বাজেটে। কারণ এই তিন রাজ্য বিজেপিশাসিত নয়। তাঁর ভাষায়, “বিজেপি আর মহিলাদের ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণ দুটি বিপরীতমুখী বিষয়।”
অভিষেকের মতে, পরবর্তী ‘ডি’ অক্ষরটি ‘ডিপ্রাইভ’ অর্থাৎ বঞ্চনার প্রতীক। তিনি ফের বলেন, “২০,০০০ কোটি খরচ করা হয়েছে সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পে। বড়লোকদের, প্রভাবশালীদের ঘর-বাড়ির জন্য এই প্রকল্প। কিন্তু শহরে, গ্রামে যারা গৃহহীন, তাদের জন্য আপনারা কী করেছেন? কেন্দ্র বাংলাবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। বাংলার সংস্কৃতিকে অশ্রদ্ধা করেছে কেন্দ্র! রাজ্যের ভাবমূর্তিকে ক্ষূণ্ণ করতে ষড়যন্ত্র করেছে।” এরপর অর্থমন্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে যুবরাজ বলেন, “রাজ্যসভায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলা নাকি কেন্দ্রের আর্থিক সহায়তার প্রকল্পগুলিকে বাস্তবায়িত করতে পারেনি। আমি তাঁকে শুধু শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে বলছি। ২০২১ সালে বাংলায় হারার পর, কেন্দ্র কোন প্রকল্পে কত টাকা বাংলায় দিয়েছে, তা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বলুন। আমরা শ্বেতপত্র চাইছি তা দিতে পারছে না, আবার গোটা দেশের কাছ থেকে সিএএ এর নামে কাগজ চাইছে! এটাই বিজেপি! বাংলার প্রাপ্য অর্থ আদায়ের জন্য তৃণমূল নেতৃত্বদের আন্দোলন করতে হয়েছে, এমনকি তৃণমূলের মহিলা সাংসদরাও দিল্লি পুলিশ কর্তৃক অপমানিত হয়েছে! এই বিজেপি নারী শক্তির কথা বলে?” তৃণমূলের সাংসদদের মধ্যে ৩৮ শতাংশই মহিলা, জানিয়ে দেন অভিষেক।
এবার ‘জি’-এর অর্থ গ্যারান্টি। অভিষেক বলেন, “নোট বাতিলের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন কালো টাকা আর থাকবে না। কিন্তু তিনি সেই কথা রাখতে পারেননি। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সকল ভারতীয়কে ২০২২-এর মধ্যে বাড়ি করে দেওয়া, বুলেট ট্রেন, কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ করা, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ জল পৌঁছে দেওয়া – গ্যারান্টি দিয়ে কোনওটিই তারা পূরণ করতে পারেনি। নিট পরিচালনায় ব্যর্থতা, এই সরকারের অন্যতম বড় ব্যর্থতা।” এরপর অভিষেকের ভাষায়, বাজেটের ‘ই’ এর অর্থ এক্সেন্ট্রিক অর্থাৎ খামখেয়ালিপনা। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদীর খামখেয়ালিপনা এই সরকারকে সার্কাসে পরিণত করেছে। পরিকল্পনাহীন লকডাউন ঘোষণা, কৃষি বিল জারি, নোট বাতিল – একের পর এক খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হয়েছে ভারতীয়দের।” যদিও এক্ষেত্রে স্পিকার অভিষেককে থামিয়ে বলেন, কৃষক বিল নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছিল। এতেই সহমত জ্ঞাপন করেন বাকি বিজেপির সাংসদগণ।
অভিষেকের পাল্টা দাবি, “কৃষক বিল নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি! আর যাঁরা এখন তালি বাজাচ্ছেন বা সহমত জ্ঞাপন করছেন তাঁরা কি একবারও ৭০০ জন মৃত কৃষকদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিলেন? আপনাদের হাতে কৃষকদের রক্ত লেগে আছে!” এরপরই তিনি বলেন, “বিজেপি অভিযোগ করছে, আমি কাগজ দেখে বলছি বলে। আর প্রধানমন্ত্রী টেলিপ্রম্পটার দেখে বলেন!” এরপর বাজেটের শেষ অক্ষর ‘টি’ হলো ‘ট্র্যাজেডি’ অর্থাৎ বিপর্যয়ের প্রতীক। তিনি বলেন, “কলকাতায় কয়েক বছর আগে যখন ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ে গিয়েছিল, তখন মোদী বলেছিলেন, এটা অ্যাক্ট অব গড নয়, অ্যাক্ট অব ফ্রড। মোরবি ব্রিজ ভেঙে পড়া, দিল্লির এয়ারপোর্টের ছাদ ভেঙে পড়া, রাম মন্দিরের ছাদ থেকে জল পড়া, অটল সেতুতে ফাটল ধরা, উত্তরাখণ্ডের সূড়ঙ্গে শ্রমিকদের আটকে পড়া, বালাসোরে ট্রেন দুর্ঘটনা – এগুলো কি ছিল? অ্যাক্ট অব গড না, অ্যাক্ট অব ফ্রড? রেলমন্ত্রীর হাতে রক্ত লেগে আছে।”