এই সময়: সপ্তাহের প্রথম চারটে কাজের দিন, সোম থেকে বৃহস্পতিবার, কলকাতা হাইকোর্টের কাজকর্ম শিকেয় উঠেছে। আইনজীবীদের বৃহত্তম সংগঠন বার অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিল। যার ফলে চার দিন কার্যত বন্ধ ছিল আদালতের কাজ। এর মধ্যে সোমবার সকাল থেকে কাজ বন্ধের পিছনে ছিল, এক আইনজীবীকে থানায় এক পুলিশ অফিসারের মারধরের অভিযোগ।আবার, অসুস্থ হয়ে দুই আইনজীবীর মৃত্যুতে শোক জানাতে মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার ছিল কর্মবিরতি। বুধবার দুপুর সওয়া ৩টেয় আদালত বন্ধ হয়ে যায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শিবকান্ত প্রসাদের মৃত্যুতে স্মরণসভার জন্য। আইনজীবীদের ডাকে সকাল থেকে কাজ বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘ভয়ের আবহ তৈরি করে শোকের কর্মবিরতি’ বলে মন্তব্য করলেন বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী।
পর পর কয়েক দিন সকালে আদালতের কাজ শুরু হওয়ার পরেই আইনজীবীরা কাজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এ রকমটা দেখতে দেখতে বৃহস্পতিবার এজলাসে কার্যত বিস্ফোরণ ঘটান বিচারপতি বাগচী। এই ভাবে সকাল থেকে শোক প্রকাশের কারণ দেখিয়ে আইনজীবী সংগঠনের কাজ বন্ধের যুক্তিকে বিচারপতি বাগচী কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন।
তাঁর কথায়, ‘ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে শোক প্রকাশের নামে কর্মবিরতি হচ্ছে। আমরা মাস্টারি করতে এখানে বসে নেই। এর দায় নিতে হবে আইনজীবীদেরই। কোর্টের কাজকর্ম এই ভাবে বন্ধ করা যায় না।’ চিটফান্ডের মামলায় স্পেশাল বেঞ্চ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিচারপতি বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চকে। এ দিন দুপুরে সেই মামলা উঠলে আদালতকে আইনজীবী শুভাশিস চক্রবর্তী অনুরোধ করেন, সপ্তাহে একদিনের পরিবর্তে দু’দিন করে এই বেঞ্চ বসানো হোক, তা হলে জমে থাকা মামলা কিছুটা কমবে।
মামলা জমে থাকায় বহু মানুষ সমস্যায় রয়েছেন। তাঁর মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে বিচারপতি বাগচী বলেন, ‘আগে সকাল থেকে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত শুনানিতে অংশ নিন, তার পর এমন অনুরোধ করলে বিবেচনা করব। আমরা সার্ভিস দেওয়ার জন্য বসে আছি। কিন্তু আপনাদের সহকর্মীরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোর্টে সকাল থেকে কর্মবিরতি করছেন।’ ক্ষুব্ধ বিচারপতির প্রশ্ন, ‘কেন সবাই শুনানিতে হাজির হচ্ছেন না? আপনাদের কোনও অধিকার নেই এমন আবেদন করার।’
পর পর চার দিন কাজ বন্ধের ফলে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে হাইকোর্টে আইনের শাসন আদৌ আছে কি না, তা নিয়েই বিচারপতি বাগচী প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘যে ভাবে এই কর্মবিরতি হচ্ছে, তা আইনের শাসনের মধ্যে হতে পারে না। সব কিছু একটা পদ্ধতি মেনে হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানে সেটা হচ্ছে না। সমাজের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা আপনাদের (আইনজীবীদের) বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষকে এর ফলে ভুগতে হচ্ছে।’
হাইকোর্টের আইনজীবীদেরই একাংশের অভিযোগ, হাতে গোনা কয়েক জন আইনজীবী সকালে ২ নম্বর বারে গিয়ে বৈঠক করার নামে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন যে, কর্মবিরতি হচ্ছে। তাঁদের বিরোধিতা করতে গেলে অন্যদের জোটে লাঞ্ছনা, হেনস্থা, গালিগালাজ। তাই, আপত্তি থাকলেও কেউ যেচে অসম্মানিত হতে চান না বলে প্রতিবাদ করেন না। তার পর ওই গুটি কতক আইনজীবীর সিদ্ধান্তই জেনারেল বডির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রকাশ্যে আসে।
আইনজীবীদের অনেকের কথায়, ‘এটা যে আসলে ভয়ের পরিবেশেই শোকের কর্মবিরতি, তা বহু আইনজীবীর মতোই বিচারপতিদেরও জানা আছে।’ এ দিন বিচারপতি বাগচী সরব হওয়ার আগে গত দু’দিন ধরে বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজ কিছুটা হালকা চালে হলেও এই কর্মবিরতি নিয়ে তাঁর অসন্তোষের কথা এজলাসেই জানিয়েছিলেন। তার পরেও পরিস্থিতির কোনও বদল হয়নি।
এ দিন বিকেলে হাইকোর্টের অলিন্দে এই নিয়ে তর্কবিতর্কের মধ্যেই খবর আসে, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা ওডিশা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন। তিনি রাজ্যের ২১ জুলাই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। আজ, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁর মরদেহ হাইকোর্টে আনা হবে শ্রদ্ধা জানাতে। ফলে দীর্ঘকালের প্রথা মেনে আজ, শুক্রবারও হাইকোর্টের কাজকর্ম সকালেই শোক প্রকাশের কারণে বন্ধ হয়ে যাবে বলে ধরে নিচ্ছেন আইনজীবীদের অনেকে।
বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শঙ্কর প্রসাদ দলপতি বলেন, ‘আগের মতো সকাল সাড়ে ১০টায় কর্মবিরতির অভ্যাসের পরিবর্তন হলেও এখনও আমাদের মধ্যে থেকে এই প্রবণতা যায়নি। এটা আমাদেরই কাটাতে হবে।’ বর্ষীয়ান আইনজীবী পার্থসারথি সেনগুপ্তর বক্তব্য, ‘কারও মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কর্মবিরতির এই ধারার বদল আমাদের করতেই হবে।’