মহানগরে কি ট্রামের বিদায়ঘণ্টা, আশা-আশঙ্কার দোলাচলে সবাই
এই সময় | ২৬ জুলাই ২০২৪
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩। শিয়ালদহ থেকে আর্মানি ঘাট স্ট্রিট পর্যন্ত রাস্তার পাশে কৌতূহলী চোখের সারি। ঘোড়ায় টানা গাড়ি শহর তার অনেক আগে থেকেই দেখে অভ্যস্ত। হাওড়া এবং শিয়ালদহ— দু’জায়গাতেই ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে রেলস্টেশন। তাহলে কি শহরের মধ্যে ট্রেন চলবে! সেটাও ঘোড়ায় টানা? শোনা গেল, লাইনের উপর চললেও আসলে ওটা ট্রেন নয়, ওটা আসলে ট্রাম।তখনও শহরবাসী জানতেন না, পরের অন্তত ১৫০ বছরের জন্য কলকাতার রাজপথে যাতায়াতের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হতে চলেছে ওই ট্রামই। তবে সেই ট্রাম কি এ বার পাকাপাকি ভাবে পাততাড়ি গোটানোর পথে? শহরের ট্রাম আরোহীদের সংগঠন ক্যালকাটা ট্রাম ইউজ়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিটিইউএ) অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে রাজ্য পরিবহণ দপ্তর ট্রামের উন্নতির জন্য কার্যত কিছুই করেনি।
সরকারের উদাসীনতায় ট্রাম আইসিইউ-এর দরজায় পৌঁছেই গিয়েছিল। ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করার সরকারি ঘোষণা এখন সময়ের অপেক্ষা বলেই আশঙ্কা করছেন ট্রামপ্রেমীরা। রাজ্যের পরিবহণ দপ্তর এখনও এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে মহানগরীর গতি বাড়াতে এবং পথদুর্ঘটনার সংখ্যা আরও কমিয়ে আনাটাই তাদের কাছে প্রাথমিক লক্ষ্য। এমনিতে কলকাতায় রাস্তা রয়েছে মাত্র ছ’শতাংশ।
তার উপর দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা ট্রামলাইনে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে পুলিশের তরফ থেকে আদালতেও যুক্তি দেওয়া হয়েছে— শহর থেকে ট্রামলাইন তুলে ফেলা হোক। উল্টো পক্ষের যুক্তিও আছে। ট্রামপ্রেমীদের অধিকাংশেরই সওয়াল, এটা পরিবেশ-বান্ধব যান। কারও যুক্তি, কলকাতার নস্ট্যালজিয়া ট্রামকে আরও আধুনিক করে রাস্তায় নামালেই তো হয়। পৃথিবীর ১২২টি শহর ট্রাম পরিষেবা তুলে দেওয়ার পরেও তা ফিরিয়ে এনেছে।
সোল, সিডনি, বার্সেলোনা, বোর্দো, ভিয়েনা, টরন্টোর মতো আধুনিক শহরেও ট্রাম চলছে। সব মিলিয়ে বিশ্বের সাড়ে চারশো শহরে এখনও ট্রাম পরিষেবা অব্যাহত রয়েছে। তাহলে কলকাতা কেন ব্যতিক্রম? অন্য শহরগুলির সঙ্গে তুলনা টেনেই আবার পরিবহণ দপ্তরের কর্তাদের যুক্তি, কলকাতার সবচেয়ে বড় সমস্যা তো এখানে যান চলাচলের যোগ্য রাস্তাই অনেকটা কম।
দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো মেট্রো শহরের তুলনায় এ দিক থেকে অনেক পিছিয়ে কলকাতা। যে হারে শহরে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে রাজপথে ট্রামের জন্য ‘ডেডিকেটেড ট্র্যাক’ রাখা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সরকারের এই যুক্তি মানতে নারাজ সিটিইউএ-র সদস্যরা। সংগঠনের সভাপতি দেবাশিস ভট্টাচার্য বলছেন, ‘ট্রামকে যানজটের জন্য দায়ী করা কুযুক্তি ছাড়া কিছু নয়। ইএম বাইপাসে তো ট্রামের ট্র্যাক নেই। তাহলে সেখানেও যানজট হচ্ছে কেন?’
প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার কোনও ঘোষণা করা হয়নি। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ বছর আগেও শহরে ৪০টি রুটে প্রায় ৪০০টি ট্রাম চলত। তখন কলকাতায় ট্রাম লাইনের বিস্তার ছিল ৬৭ কিলোমিটার। আর ২০২৪-এ এসে শহরে মাত্র তিনটি রুটে ট্রাম চলছে।
কয়েক বছরের মধ্যে ট্রামের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা থেকেই ট্রামপ্রেমীদের আশঙ্কা, আসলে ধীরে ধীরে তুলেই দেওয়া হচ্ছে এই ঐতিহাসিক যান। তারপরই কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। কোর্টের নির্দেশ, ট্রাম নিয়ে সরকারের নীতি কী, সেটা আগে স্পষ্ট করতে হবে। এই প্রসঙ্গে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘মহামান্য আদালত আমাদের কাছে যা জানতে চেয়েছেন, আমরা আদালতকে সেটা জানাব। ট্রাম বন্ধ হয়ে যাবে, এ কথা এখনই বলার অবস্থায় আমরা নেই।’
মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, যে ভাবে ট্রামের ট্র্যাকে পর পর দুর্ঘটনা ঘটছে, সেটা পুলিশের কাছে চিন্তার কারণ। ট্রাম বেলাইন হলে তার জন্যও দীর্ঘ সময় ধরে কোনও রাস্তা অচল হয়ে যাচ্ছে— এটাও ভাবার বিষয়। শহরের বিশিষ্ট নাগরিকদের একটা বড় অংশ অবশ্য ট্রাম নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এঁদের অন্যতম সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
তিনি বলছেন, ‘কলকাতায় অসুবিধা হলে নিউ টাউনের দিকে ট্রামকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ট্রাম যেন বন্ধ না হয়ে যায়।’ আবার চলচ্চিত্র পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন জোর দিয়েছেন ট্রামের ঐতিহ্য রক্ষার উপর। ট্রাম রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন পুরোনো কলকাতা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং পেশায় চিকিৎসক দেবাশিস বসুও।
তিনি বলছেন, ‘একটা সময়ে সুতির জামা বাদ দিয়ে টেরিকটের বাজার এসেছিল। এখন আবার সুতি ফিরেছে। ঠিক তেমনই আজ ট্রাম তুলে দিলে কয়েক বছর পর ফের বিস্তর খরচ করে ট্রাম ফিরিয়ে আনতে হবে।’ তাই একরাশ আশঙ্কা নিয়েও শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ট্রাম টিকে যাওয়া নিয়ে আশাবাদী ট্রাম-আরোহীরা।