জেলের কুঠুরিতে বসে তৈরি ব্লু প্রিন্টেই থরহরি সাত রাজ্যের পুলিশ
এই সময় | ২৬ জুলাই ২০২৪
জঙ্গিগোষ্ঠীর মোড অফ অপারেশন ফলো করত গ্যাংস্টার সুবোধ সিং। দলের এক সদস্যের কাছে অজানা থাকত অন্য জনের বিস্তারিত পরিচয়। সুবোধের দেওয়া নিকনেমই ছিল তাদের একমাত্র পরিচয়। এতে একজন ধরা পড়লেও অন্যজনের নাম পুলিশ জানতে পারত না। শুধু সুবোধের একেবারে ট্রাস্টেড কয়েকজন পুরো অপারেশনটা জানত।বিহারের বেউর জেলের ২২ নম্বর কুঠুরিতে বসেই তৈরি হতো অপারেশনের ব্লু-প্রিন্ট। সুবোধের এমন ব্লু প্রিন্ট কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল কয়েকটি প্রদেশের পুলিশের। সেই সুবোধ এখন ব্যারাকপুর পুলিশের ‘অতিথি’। আপাতত তার ঠিকানা বেলঘরিয়া থানা।কলকাতার উপকণ্ঠে সেই থানা এখন কার্যত দুর্গে পরিণত। ঢোকার মূল গেট বন্ধ।
কোলাপ্সিবল গেটের ওপারে ইনসাস রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে পুলিশের বিশেষ বাহিনী ‘স্ট্রাকো’ (স্পেশালি ট্রেইনড আর্মড কোম্পানি)-র কর্মী। লকআপের সামনে আরও কড়া নজরদারি। সেখানে স্ট্রাকোর পাশাপাশি পুলিশেরও বিশেষ নজরদারি। তালা বন্ধ পিছনের গেট। গত শনিবার থেকে থানার লকআপে রয়েছে সুবোধ ও তার ডানহাত রোশন যাদব। দু’জনকেই বেলঘরিয়ার ব্যবসায়ী অজয় মণ্ডলের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জেরা করছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, সুবোধ ও রোশনের নিরাপত্তায় ১২ জন পুলিশ কর্মী মোতায়েন হয়েছে। লকআপের মধ্যে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরা। বাথরুমে যেতে গেলেও সামনে পিছনে দু’জন পুলিশকর্মী সঙ্গে যাচ্ছেন। পুলিশের দাবি, জেরার আগে তদন্তকারী অফিসারের র্যাঙ্ক জানতে চাইছে সুবোধ। থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক এবং আইপিএস অফিসার ছাড়া কারও সামনেই মুখ খুলছে না সে।
বেউর জেলের এলাহি জীবন ছেড়ে বেলঘরিয়া থানার লকআপে আর পাঁচটা অভিযুক্তের মতোই কাটছে সুবোধ-রোশনের দিন। মেঝেতে একটি কম্বলই সম্বল। সকালের চায়ের সঙ্গে মুড়ি-চানাচুরে ব্রেকফাস্টের পর দুপুরে সব্জি-ভাত, বিকেলে চা-বিস্কুট এবং রাতে রুটি-সব্জি বরাদ্দ। পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘বরাহনগরে ডাকাতি, মণীশ শুক্লা খুন বা হালফিলে অজয় মণ্ডলের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলির কথা সুবোধ স্বীকার করলেও চোখেমুখে উদ্বেগের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। সর্বদাই সে হাসিখুশি।’
সুবোধের গ্যাংস্টার হয়ে ওঠার পিছনেও রয়েছে অবাক করা কাহিনি। অপরাধ জগতে পা রাখার সময়ে নিজের দল বানাতে প্রথমে সে অপরাধীদেরই টার্গেট করেছিল৷ বিহার থেকেই উত্থান হওয়া সুবোধ অপরাধীদের জেল থেকে ছাড়িয়ে, বিভিন্ন সাহায্যের প্রলোভন দেখিয়ে নিজের দলে টেনে নিত। স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলিয়ে তার দলে ছিল কয়েক হাজার সদস্য।
স্থায়ীদের মাসিক বেতন এবং অস্থায়ীদের ডাকাতিতে কমিশনের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। ডাকাতির জন্য মূলত বেছে নেওয়া হতো সোনার দোকান। মূল অপারেশনে থাকতো বিহারের বাসিন্দারাই। বাইক পৌঁছে দেওয়া, নির্দিষ্ট এলাকায় আশ্রয় দেওয়া, অপারেশন স্থল চিহ্নিত করা, রেকি করার প্রতিটি ধাপেই আলাদা আলাদা বাহিনী থাকত৷
বিশাল এই সাম্রাজ্য চালানোর বিপুল খরচ জোগাতে সুবোধ জেলে বসেই তোলাবাজির সিন্ডিকেট চালাত। এই সিন্ডিকেট পরিচালনার ক্ষেত্রে এলাকা ধরে ধরে সুবোধের আলাদা আলাদা লিঙ্কম্যানও রয়েছে। তাদের দায়িত্ব এলাকায় কোথায় কী হচ্ছে, সে সব খবর সুবোধের কান পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। তার পরই সুবোধ প্ল্যান সাজাতো। শুরু হতো ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়।
পুলিশের দাবি, তোলাবাজির সেই টাকা সম্প্রতি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রোমোটিং ব্যবসাতেও খাটানোর ছকও কষেছিল সুবোধ। সে কারণেই ব্যবসায়ী অজয়ের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে ব্যারাকপুরের ব্যবসায়ীদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল সে। পুলিশের একাংশের দাবি, ব্যবসায়ীরা ভয় পেলে তোলাবাজি ও প্রোমোটিংয়ে টাকা খাটানোর ক্ষেত্রে বিশেষ বেগ পেতে হতো না সুবোধকে।