• ‘গরম রক্তে ভিজছে খাঁকি, কফিনবন্দি করছি দেহ’, বিজয়দিবসে স্মৃতিতে ডুব কাটোয়ার কার্গিল যোদ্ধার
    বর্তমান | ২৭ জুলাই ২০২৪
  • অনিমেষ মণ্ডল: একের পর এক আছড়ে পড়ছে গোলা। কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে গুলি। এই বুঝি মাথার খুলিটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে! দ্রাসে তখন মাইনাস ডিগ্রি। কিন্তু কনকনে ঠান্ডা কোথায়? চারিদিকে শুধু আগুনের ঝলকানি। বাতাসে বারুদের গন্ধ। কোথাও কোথাও ফিট সাদা বরফের চাঁই টকটকে লাল হয়েছে জওয়ানদের রক্তে! কেউ ছটফট করছেন। কেউ বা নিথর। আমার দায়িত্ব ছিল, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জখমদের দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো। শহিদদের কফিনবন্দি করা। 

    শুক্রবার, ২৬ জুলাই গোটা দেশে পালিত হল কার্গিল বিজয় দিবস। কাটোয়া শহরের বাড়িতে বসে সেই কার্গিল যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছিলেন পল্লবকুমার চট্টোপাধ্যায়। ২৫ বছর পরও যুদ্ধের প্রতিটি দিনের ঘটনাক্রম তাঁর স্মৃতিতে এখনও টাটকা। তারপর এল জয়। অনেক সহযোদ্ধাকে হারিয়ে সবার মুখে বিজয়ের হাসি। পালিত হল বিজয় দিবস। দ্রাসে উড়ল ভারতের জাতীয় পতাকা। ‘নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও সে এক আলাদা আনন্দ-অনুভূতি!’ চোয়াল শক্ত করে গর্বের হাসি হাসলেন পল্লববাবু। যুদ্ধে ব্যবহৃত খাঁকি পোশাকটি এখনও সযত্নে গচ্ছিত তাঁর দামি আলমারিতে। প্রতি বছর এই দিনে সকাল সকাল স্নান সারেন স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই। পোশাকটি বের করে এনে টেবিলে রাখেন। চারপাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিজের মতো করে বিজয় দিবস পালন করেন কার্গিল যোদ্ধা। 

    পোশাকটি দেখিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সিআরপিএফ জওয়ান বলছিলেন, ‘ওটাই আমার অহঙ্কার, সেরা অলঙ্কারও।’ বলেই ফের ফিরলেন দ্রাসে, যুদ্ধক্ষেত্রে—‘গোলাগুলি শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের দ্রাসে চলে যাওয়ার নির্দেশ আসে। দ্রাস থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরেই কারগিল। শত্রুপক্ষ বিরামহীনভাবে গোলা বর্ষণ করছে। মর্টার ছুড়ছে। আমাদের যোদ্ধারও মুখতোড় জবাব দিচ্ছেন। মাতৃভূমি রক্ষার প্রাণপণ লড়াই। একের পর এক সহযোদ্ধা গুলি খেয়ে কিংবা গোলা বিস্ফোরণে লুটিয়ে পড়ছেন।  গরম রক্তে ভিজে যাচ্ছে আমার খাঁকি। তবুও আমার অফুরান মনের জোর। সবারই তাই। তীব্র যন্ত্রণায় কাতর সহকর্মীকে সাহস জোগাচ্ছি। কখনও আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। কেউ কেউ উঠে দাঁ‌঩ড়িয়েছেন। ফের যুদ্ধ করেছেন। কেউ পারেননি। আমার সাহস জোগানো বিফলে গিয়েছে। শহিদ হয়েছেন। ওঁদের জন্য মনটা আজও কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে। চোখের সামনে ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যাওয়া তো! ভুলে যাওয়া বড্ড কঠিন। ভুলতেও চাই না আমৃত্যু।’ 

    যুদ্ধজয়ের পর বাড়ি ফিরছেন পল্লববাবুরা। বিজয় উৎসবে মেতেছে গোটা দেশ। সেনাদের নামে জয়ধ্বনী। পল্লববাবু সহ আরও কয়েকজন সেনা জম্মুতে ট্রেন ধরেছেন। আসন সংরক্ষণ করার সময় পাননি। সেই দিনটির কথা মনে পড়তে দু’চোখ চিকচিক করে ওঠে পল্লববাবুর। বলছিলেন, ‘আমরা ট্রেনে ওঠা মাত্রই প্রত্যেক যাত্রীকে দেখলাম সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সেইসব সিটে আমাদের বসতে দিয়ে তাঁদের সে কি উল্লাস! গর্বে আমাদের বুকটা সেদিন চওড়া হয়ে গিয়েছিল।’

    ১৯৮৮ সালে মধ্যপ্রদেশে সিআরপিএফ জওয়ান পদে যোগদান করেছিলেন কাটোয়ার মোস্তফাপুরের বাসিন্দা পল্লববাবু। পরে স্ত্রী রমা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কাটোয়া শহরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের স্টেডিয়াম পাড়ায় উঠে আসেন। সিআরপিএফের ৩৮ নম্বর বাটালিয়নে যোগদান করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করার পর কার্গিল যুদ্ধ চলাকালীন পল্লববাবুর টিম দ্রাসে পোস্টিং পায়। পল্লববাবুর দায়িত্ব ছিল যুদ্ধে জখমদের সেবা-শ্রুশুষা করা। জখমদের তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। শহিদদের কফিনবন্দি করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরত পাঠানো। ২০০৯ সালে অবসর গ্রহন করেছেন পল্লববাবু। এখন তাঁর অবসর সময় কাটে কবিতা আর গানে। (নিজস্ব চিত্র)
  • Link to this news (বর্তমান)