সারদার পরে গোরু পাচার। এরপর রেশন দুর্নীতির মামলা। প্রায় সবক্ষেত্রে কমন একটাই, একটি লাল ডায়েরি। নদিয়া থেকে এমনই এক লাল ডায়েরির হদিশ পেয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। সেখান থেকে পাওয়া গিয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।কী রয়েছে সেই রহস্যময় ডায়েরিতে?
সূত্রের খবর, ডায়েরির পাতায় পাতায় রয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার বেআইনি লেনদেনের হিসেব। অথচ যাঁদের মধ্যে টাকার হাতবদল হয়েছে, আইন বলছে, তাঁদের মধ্যে কোনও আর্থিক লেনদেন হওয়ার কথাই নয়। নিয়ম অনুযায়ী, খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তর রেশনের ডিস্ট্রিবিউটর এবং ডিলারদের বিক্রির বিনিময়ে কমিশন দিয়ে থাকেন। ইডি হাইকোর্টে নথি দিয়ে দাবি করেছে, ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’ (এফসিআই)-র গুদাম থেকে বরাদ্দ গম আটা কলে আনা হয়।
সেই গম ভেঙে ‘ফর্টিফায়েড’ আটা তৈরি করা হয়। পরিবহণ খরচ এবং আটা তৈরিতে প্রতি কুইন্টালের জন্য ২৯ টাকা পান আটাকল মালিকেরা। ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে সেই আটা পৌঁছনোর কথা ডিলারদের ঘরে, অর্থাৎ রেশন দোকানে। সেখান থেকে তা পান গ্রাহকেরা। ধরা যাক, বরাদ্দ ৫০০০ কুইন্টাল গম ভাঙার কথা আটাকলের।
অথচ বরাদ্দের অর্ধেক গম না ভেঙে তা খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে ২৯ টাকা কেজি দামে। বাকি ২৫০০ কুইন্টাল গমের জন্য ডিস্ট্রিবিউটরদের প্রতি কেজি ২৭ টাকা নগদে দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে আটাকল মালিকরা ৫০০০ কুইন্টাল গম ভাঙানোর কমিশন পান। আবার ২৫০০ কেজি গম বিক্রির টাকাও পকেটস্থ করে ফেলেন।
এবার সেই আটা ডিস্ট্রিবিউটদের মাধ্যমে ডিলারদের কাছে যাওয়ার কথা। সেই হিসেবে বরাদ্দের অর্ধেক আটা দিয়ে বাকি ২৫০০ কেজির জন্য প্রতি কেজিতে ২৫ টাকা করে পেয়ে যান ডিলাররা। সঙ্গে কুইন্টাল প্রতি ২৯ টাকা পরিবহণ খরচও। ইডি আদালতে ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, রেশন দুর্নীতিতে ২০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে। সেই টাকার একটা বড় অংশ গিয়েছে এই মামলায় ইডি’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়া রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কাছেও।
আবার এই চক্রান্তে যুক্ত থাকার অভিযোগে চাল ও আটা কল মালিক বাকিবুর রহমান-সহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা লাল ডায়েরিতে রয়েছে এমনই সব লেনদেনের বেশ কিছু তথ্য। রেশন দুর্নীতির তদন্তে ইডি মূলত নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা এবং পূর্ব বর্ধমানের কয়েকটি চাল ও আটা কল এবং কয়েকটি অফিসে হানা দিয়েছিল। সেই অভিযানে লাল ডায়েরিটি পাওয়া যায় বাকিবুরের আটাকল থেকে।
নথি বাজেয়াপ্ত করার সময়ে যে দু’জনকে সাক্ষী হিসেবে সই করানো হয়, তাঁরা ওই আটাকলেরই কর্মী। এমনকী, ওই ডায়েরিতে যাঁদের নাম রয়েছে তাঁরা সকলেই ওই কারবারের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ। ডায়েরির পাতায় পাতায় কাকে-কবে-কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তার বিস্তারিত হিসেবে লিখে রাখা হয়েছে। এই লেনদেনের পোশাকি নাম ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’।
সূত্রের খবর, কেন ডিলারদের টাকা দেওয়া হয়েছে, গোয়েন্দাদের জেরায় বাকিবুর তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু টাকা কেন দেওয়া হলো? ইডির দাবি, এর পিছনে রয়েছে রেশনে গমের বদলে গ্রাহকদের আটা দেওয়ার রহস্য। দেশের অন্য কোনও রাজ্যে গমের বদলে গ্রাহকেরা আটা পান না। ইডি’র গোয়েন্দারা মনে করছেন, পুরো ব্যবস্থাতেই টাকা লেনদেনের সুবিধা নিতে এই সুযোগকে কাজে লাগানো হয়।
খাদ্য দপ্তরের অফিসারেরা জানান, গমের বদলে আটা দেওয়া শুরু হয় বাম আমলে। সেই সময়ে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃত্বের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন বাকিবুর। উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাপায় তাঁর একটি চালকল ছিল। কিন্তু বাম জমানায় আটা দেওয়া শুরু হতেই তিনি নদিয়ায় আটাকল তৈরি করেন।
তদন্তকারীদের মতে, রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা দেশে আম জনতার খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থাকে সচল রাখা হয়। খাদ্য দপ্তরের এক অফিসার বলেন, এটি সুপরিকল্পিত এবং সংগঠিত দুর্নীতি। রেশন সামগ্রী একটি চেন সিস্টেমে গ্রাহকদের হাতে পৌঁছয়। এক হাত থেকে অন্য হাতে যাওয়ার আগে মাঝ পথেই রেশন সামগ্রী সরিয়ে ফেলে দুর্নীতি করা হয়। সেই টাকার বাটোয়ারা হয়ে যায় কয়েকজনের মধ্যে। সেটা ঘটছে কী ভাবে? লাল ডায়েরিতে নাম ধরে ধরে রয়েছে তারই হদিশ। আপাতত সেগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। (চলবে)