বর্গি এল দেশে! বাংলা শ্মশান হয় মারাঠা তাণ্ডবে, কী ছিল হামলার নেপথ্যে?
প্রতিদিন | ২৮ জুলাই ২০২৪
বিশ্বদীপ দে: ‘খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়ল, বর্গি এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে?/ ধান ফুরল, পান ফুরল, খাজনার উপায় কী?/ আর ক’টা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।’ সারা বিশ্বের মতোই বাংলার বহু লোকায়ত ছড়ার গভীরে লুকনো আছে ইতিহাসের টুকরো। সেই অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার বুকে বর্গি হানার কালো অতীতের জলছাপ আজও দিব্যি রয়ে গিয়েছে এই ছেলেভুলনো ছড়ার অন্দরেই। মহারাষ্ট্রের দুরন্ত বর্গিদের আক্রমণের ভয়ে কলকাতায় খাল পর্যন্ত কাটা হয়েছিল। আজ সেই খাল নেই। রয়ে গিয়েছে তা ভরাট করে তৈরি হওয়া একটা রাস্তা। মারহাট্টা ডিচ লেন (মারাঠা থেকেই মারহাট্টা, আর ডিচ শব্দের অর্থ পরিখা)! বাগবাজারের ওই লেন আজও সাক্ষ্য বহন করে চলেছে বর্গির হিম আতঙ্কের। কিন্তু কেন বর্গিরা আক্রমণ করেছিল বাংলায়? কতটা ভয়ংকর ছিল সেই হামলার ছবি? সে ইতিহাস বড়ই বেদনার।
১৭৪০ সালে বাংলার নবাব হন আলিবর্দি খাঁ। মুর্শিদকুলি খাঁর নাতি সরফরাজ খাঁকে হত্যা করে তিনি মসনদে বসেন। যে কোনও মুকুটই আসলে কাঁটার হয়। আলিবর্দিও তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন। যুদ্ধবিগ্রহ, বিদ্রোহ দমন করতে করতেই কেটে গেল দুটো বছর। এই সময়ে দিল্লির মসনদে মির্জা নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ। তাঁকে কর দেওয়ার কথা থাকলেও বাংলার নবাব হয়ে আলিবর্দি কিছুই দেননি। এই করের এক-চতুর্থাংশ আবার যেত মারাঠাদের কোষাগারে। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে তেমনই চুক্তি ছিল তাদের। একে বলা হত চৌথ। স্বাভাবিক ভাবেই আলিবর্দির কাছ থেকে কোনও অর্থ না পাওয়ায় মারাঠাদের ঝুলিও রইল শূন্য। তারা মুঘল সম্রাটের দ্বারস্থ হলে তিনি সোজা বলে দিলেন, তারাই বরং আলিবর্দির কাছ থেকে নিজেদের হিসসা বুঝে নিক। এই পরিস্থিতিতেই বর্গি হানার সূত্রপাত।
‘বর্গি’ শব্দটা কোথা থেকে এল? মারাঠি শব্দ ‘বার্গির’ থেকে নাকি এর উৎপত্তি। যার অর্থ ‘হালকা অশ্বারোহী’। অর্থাৎ দ্রুতবেগে গতিশীল অশ্বারোহীর দল। সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসত বর্গিরা। আর মুহূর্তে তছনছ করে দিত সব! যাই হোক, আলিবর্দির কাছে ফেরা যাক। তিনি তখন উড়িষ্যার বিদ্রোহ দমন করে ‘বাড়ি’ ফিরছিলেন। সেই সময়ই খবর আসে নতুন বিপদের। সেটা এপ্রিল মাস। অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। তিনহাজার ঘোড়সওয়ার ও একহাজার পদাতিক সেনা নিয়ে বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে ‘চৌথ’ আদায় করতে আসছেন ভাস্কর পণ্ডিত। মারাঠা মহারাজা রঘুজি ভোঁসলের প্রধানমন্ত্রী। ১৫ এপ্রিল বর্ধমানে ঢুকে পড়ল বর্গিরা। শুরু হল লুঠতরাজ। এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেসব চলতে চলতেই দ্রুত সেখানে উপস্থিত হল নবাবের সেনা। সেই যুদ্ধে কিন্তু আলিবর্দি পরাস্তই হলেন।
কেননা উড়িষ্যার যুদ্ধশেষে বহু সৈন্যকে তিনি ছুটি দিয়ে দেন। অবশিষ্ট সৈন্যও ক্লান্ত। তরতাজা ও সুপ্রশিক্ষিত বর্গিরা বেকায়দায় ফেলে দিল নবাবকে। এদিকে ভাস্কর পণ্ডিতের দাবি করা ১০ লক্ষ টাকা দিতেও রাজি নন তিনি। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে রাজি হলেন বটে। কিন্তু মারাঠারা বেঁকে বসে বলল, টাকাটা বাড়িয়ে ১ কোটি করা হল! বাংলার বুকে সে এক চরম দুঃসময়। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেল বর্গি হানায়। পরে বর্ষায় তারা কিছুটা সমস্যায় পড়ল। আশ্বিনে ফের লড়াই। এবার বর্গিরা হার মানল বটে। কিন্তু ততদিনে অসংখ্য গ্রাম শ্মশান হয়ে গিয়েছে! এই বিপুল ক্ষতিতে রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামোও যেন ভেঙে পড়ার জোগাড়। শোনা যায়, কেবল জগৎ শেঠের বাড়ি থেকেই নাকি আড়াই কোটি টাকা লুঠ করা হয়েছিল।
সেই শুরু। আলিবর্দির কাছে হেরে বর্গিরা পিছু হঠলেও বারে বারে তারা ফিরে এসেছে শস্যশ্যামলা বাংলার মাটিতে হানা দিতে। ধনসম্পদ লুঠ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নারীর উপর অত্যাচারও কম হল না! কবি গঙ্গারাম দেবের ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’-এ রয়েছে ‘এই মতে যত সব গ্রাম পোড়াইয়া/ চতুর্দিকে বরগি বেড়ায় লুটিয়া।’ নির্যাতনের ছবি আঁকা হয়েছে এভাবে- ‘রুপি দেহ রুপি দেহ বোলে বারে বারে/ রুপি না পাইয়া তবে নাকে জল ভরে।।/ কাহুকে ধরিয়া বরগি পখইরে ডুবাএ।/ ফাফর হইঞা তবে কারু প্রাণ জাএ।’ আবার ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যে’ পাওয়া যায় ‘কি কহিব বাঙ্গালার যে দশা হইল।।/ লুটিয়া ভুবনেশ্বর যবন পাতকী।/ সেই পাপে তিন সুবা হইল নারকী।।’ সামগ্রিক ছবিটা কিন্তু বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না। প্রবল নির্যাতন ও নিরীহ গ্রামবাসীকে লুঠ করাই কেবল নয়, একেবারে ধনেপ্রাণে মেরে ফেলা। আতঙ্কে মানুষের জীবন দুঃস্বপ্নে পরিণত হল। এমনও বর্ণনা রয়েছে যে, গর্ভবতী মহিলারাও অসহায়ের মতো প্রাণ ও মান বাঁচাতে গ্রামের পথ দিয়ে ছুটছেন। কার্যতই বাড়ি থেকে কখনও না বেরনো মহিলারাও মাথায় মালপত্র নিয়ে পালাতে লাগলেন। গ্রামের পর গ্রাম কেবল পোড়া ঘরবাড়ি ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বাকি চিহ্ন। বর্গি হানার অব্যবহিত পরে যে আর্ত চিৎকার ও মহিলাদের তীব্র কান্না তাও নেই। কেন না কেউই যে জীবিত নেই। পুরো গ্রামটাকে শ্মশান বানিয়ে পরের গ্রামে চলে গিয়েছে বর্গিরা!
এখানে আরও দুজনের কথা বলা যেতে পারে। উড়িষ্যার দেওয়ান মীর হাবিব। যে সরফরাজ খাঁকে মেরে বাংলার নবাব হন আলিবর্দি, তাঁরই কাছের মানুষ তিনি। এবং সরফরাজের জামাই রুস্তম জঙ্গ। ১৭৪২ সালে তাঁদের করা বিদ্রোহ দমনে উড়িষ্যা গিয়েছিলেন আলিবর্দি। পরে এঁরাই নাকি মারাঠাদের উসকানি দেন। এবং বাংলার নবাব, তাঁর সেনা ও আশপাশ সংক্রান্ত জরুরি তথ্যও তুলে দেন বর্গিদের হাতে। ফলে ভাস্কর পণ্ডিতরা রীতিমতো পরিকল্পনা করেই আক্রমণ করতে পেরেছিলেন বলেই মনে করা হয়।
যাই হোক, পরবর্তী সময়ে এই ভাস্কর কিন্তু মারা যান আলিবর্দির হাতে। নিজের শিবিরে ডেকে কৌশলে তাঁকে হত্যা করেন বাংলার নবাব। ততদিনে তিনবার হামলা চালিয়ে ফেলেছে বর্গিরা। কিন্তু ভাস্করের মৃত্যুতেও বর্গিদের দমানো যায়নি। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১- মোট ৬ বার বর্গিরা বাংলায় হানা দিয়েছিল। রঘুজি ভোঁসলে নিজে নেতৃত্ব দেন কয়েকটি হামলার। তিনি ছাড়াও মীর হাবিবকেও দেখা গিয়েছে বর্গি হানাদারদের নেতা হিসেবে! রঘুজির পুত্র জানুজিও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বর্গিদের। শেষপর্যন্ত আলিবর্দির সঙ্গে চুক্তি হয় মারাঠাদের। তিনি ‘চৌথ’ দিতে রাজিও হন। ফলে থেমে যায় বর্গি হানা। কিন্তু ধ্বংস ও মৃত্যুর যে করুণ ছবি ওই কয়েক বছরে বাংলা দেখেছিল তা আজও ইতিহাসের হারানো বাঁকে রয়ে গিয়েছে। নবাব ও বর্গি সেনার লড়াইয়ে যে ‘উলুখাগড়া’দের প্রাণ গিয়েছিল, তাদের অসহায় মৃত্যু ও নির্যাতন প্রচলিত এক ছড়া ও সেযুগের সাহিত্যের মাধ্যমে নিজেদের জানান দিয়ে চলেছে আজও।