শিশুদের গাছতলার পাঠশালা নজর কাড়ে হাবড়ায়, গুরুদক্ষিণা ১ টাকা
বর্তমান | ২৯ জুলাই ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি, বারাসত: বেসরকারি জাহাজ সংস্থায় নাবিক পদে অস্থায়ী চাকরি করেন। মাস বেতনের নিশ্চিত চাকরি নয়। বছরে আট মাস জাহাজে থাকতে হয়। আট মাসের বেতনের টাকায় ১২ মাস সংসার চালানোর কষ্ট আছে. তবুও সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ তাড়া করত। সেই তাড়না থেকে হাবড়ার কুমড়ো পঞ্চায়েতের টুনিঘাটা গ্রামের সঞ্জীব কাঞ্জিলাল শিশুদের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তপশিলি জাতি অধ্যুষিত এলাকা ও স্থানীয় অঞ্চলের দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের পড়াতে শুরু করেন। এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন আরও কয়েকজন। সবাই মিলে গড়ে তোলেন একটি পাঠশালা। নাম দেন ‘এক টাকার পাঠশালা’। বছর পাঁচেক আগে হাবড়ার টুনিঘাটা গ্রামে নিজের বাড়ির সামনে ১৬ ফুটের একটি ঘরে জনা পাঁচেক শিশুকে নিয়ে পথচলা শুরু করেছিল পাঠশালাটির। সেই স্কুলে এখন পঞ্চাশের বেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে। সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন স্থান সংকুলান। তবে স্থায়ী কোনও বাড়ি নেই বলে গাছের তলাতেই চলে পঠনপাঠন।
হাবড়ায় গৌরবঙ্গ রোড ধরে বেশ কিছু দূর গেলে কুমড়ো পঞ্চায়েতের টুনিঘাটা গ্রাম। এই গ্রামেই রয়েছে এক টাকার পাঠশালাটি। প্রতি মাসে এক টাকা বেতনের বিনিময়ে পড়াশোনা করে বাচ্চারা। কবিতা, আবৃত্তি, অঙ্ক, থেকে তবলা বাজানো পর্যন্ত শেখে। টুনিঘাটা, পাড়ুইপাড়া ইত্যাদি গ্রাম থেকে আসা পড়ুয়ারা সকলেই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের। তাই পড়ানোই শুধু নয় তাদের বই-খাতা-কলম-পেন্সিলও দেওয়া হয় ওই এক টাকার বিনিময়ে। প্রতি বছরই পুজোর সময় পড়ুয়ারা নতুন জামা পায়। শীতেও গরম জামাকাপড় পায়। যখন চারজন মাত্র পড়ুয়া ছিল তখন কেমন ছিল পাঠশালা? চলার পথটিও বা কেমন ছিল?
হাবড়ার টুনিঘাটা, পাড়ুইপাড়া, বয়েরঘাটা গ্রামগুলির চেহারা-চরিত্র একেবারেই সাদামাটা। বাসিন্দাদের অধিকাংশ তপশিলি জাতি, উপজাতি সম্প্রদায়ের। দিন আনা দিন খাওয়া সব পরিবার। সর্দার, মাহাত, মণ্ডল, হাজরাদের বসবাস। অধিকাংশ পুরুষ হয় দিনমজুর না হলে বিল থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ চাষের কাজ করেন। মহিলারা মাঠে বা অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। তাঁদের সন্তানরা প্রাথমিক স্কুলে যায়। তবে অনিয়মিত। আর আর্থিক সঙ্গতি নেই বলে বাড়িতে শিক্ষক রেখে প্রাইভেট টিউশন দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না পরিবারগুলি। স্কুলে শিক্ষাদান পদ্ধতি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন টুনিঘাটার সঞ্জীব কাঞ্জিলাল, সুস্মিতা বিশ্বাস, সায়ন বাগচি, অমৃত বিশ্বাস, রাহুল মহন্ত, ছন্দা মজুমদার নামের কয়েকজন মানুষ। তাঁরাই গড়ে তোলেন এক টাকার পাঠশালা। সঞ্জীববাবু বলেন, ‘পড়ুয়াদের কাছ থেকে এক টাকা করে গুরুদক্ষিণা নেওয়া হয়। যাতে বাচ্চাদের অভিভাবকরা বোঝেন, আমরা বিনা পয়সায় টিউশনি দিয়ে অনুগ্রহ করছি না। এই টাকাটাই শিশুদের পেন, খাতা ও অন্যান্য সামগ্রী কিনতে খরচ করি।’ তিনি জানান, প্রথম অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করতে অনেক বাধা ছিল। কিন্তু হাল ছাড়া হয়নি। এখন অভিভাবকদের মধ্যেও এক টাকার পাঠশালার নিয়ে ভরসা তৈরি হয়েছে। পাঠশালার নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নেই। বেশিরভাগ সময় গাছের তলায় পড়াতে বসতে হয়। সুস্মিতা বিশ্বাস, ছন্দা মজুমদাররা বলেন, ‘এই এলাকার মানুষ আর্থিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে। তাঁদের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।’ প্রীতম সাঁতরা, তৃষা সাঁতরা, পার্থ কবিরাজ নামেন ছাত্র-ছাত্রীরা বলেন, ‘এখানে আমরা অন্যভাবে পড়াশোনা করি। গান, আবৃত্তি, নৃত্যগীত, সব কিছুই শিখছি। স্যারেরা খুব ভালোভাবে যত্ন নিয়ে পড়ান।