নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: ‘তিস্তার জল দেওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে, যদি উত্তরবঙ্গের মানুষকে বাঁচাতে হয়। কেন্দ্র একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ধিক্কার জানাচ্ছি।’—এই চাঁচাছোলা মন্তব্যের মধ্য দিয়েই অবস্থান স্পষ্ট করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝিয়ে দিলেন, রাজ্যের মানুষের স্বার্থই তাঁর কাছে আগে। রাজনীতি নয়। আর তাই তিস্তার জলকে কেন্দ্র করে মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলার সংঘাত চরম আকার নিতে চলেছে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে বিজেপির যে তাবড় নেতারা বাংলা ভাগের ধুয়ো তুলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও আপসহীন সংগ্রামের শপথ নিলেন অখণ্ড বাংলার অগ্নিকন্যা।
সোমবারের বিধানসভার অধিবেশন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে রইল। এদিন ইন্দো-ভুটান যৌথ নদী কমিশন গঠনের উপর একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। উত্তরবঙ্গের বসবাসস্থল, কৃষিজমি, বনাঞ্চল রক্ষার জন্যই এই কমিশন গঠনে গুরুত্ব আরোপ করেন মমতা। নীতি আয়োগের বৈঠকেও তা জানিয়ে এসেছেন তিনি। বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করেন, বিধায়কদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হোক। ওই কমিটি কেন্দ্রীয় সেচমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তার অন্যতম সদস্য হবেন আলিপুরদুয়ারের বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল। এই সংক্রান্ত বিষয়ে তৃণমূলের লোকসভা ও রাজ্যসভার সাংসদরাও কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলবে বলে জানান মমতা।
উত্তরবঙ্গের এই প্রসঙ্গের সূত্র ধরেই মমতা টেনে আনেন তিস্তা জল-চুক্তির প্রসঙ্গ। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, একতরফা কোনও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত তিনি সমর্থন করবেন না। তিস্তা-চুক্তির জন্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলার সঙ্গে আলোচনা করতেই হবে। মমতা বলেন, ‘কংগ্রেস আমলে কিংবা বিজেপির প্রথম জমানায় রাজ্যকে মাঝে রাখা হতো। সেইমতো আলোচনা চলত। ছিটমহল, দু’দেশের মধ্যে বাস পরিষেবা, ট্রেন চালুর সময়ও পশ্চিমবঙ্গকে মাঝে রেখে আলোচনা হয়। কিন্তু এবার দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে না জানিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একতরফা আলোচনা হচ্ছে। এটা মানা যায় না।’
মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, বাংলাকে অন্ধকারে রেখে তিস্তা নিয়ে কেন্দ্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিবাদ হবেই। বলেছেন, ‘তিস্তায় কি সেই পরিমাণ জল আছে, যা দেওয়া যাবে? বর্ষাকাল ছাড়া তিস্তায় জল থাকে না। তাছাড়া তিস্তার উপরিভাগে ১৪টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বানিয়ে রেখেছে সিকিম। বাংলার ক্ষেত্রে ওটাই অবস্ট্রাকশন। তখন কেন্দ্র চোখ-কান বন্ধ করে বসেছিল। তিস্তা নিয়ে এগনোর আগে ভাবা উচিত কেন্দ্রের। গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। নাকের ডগা দিয়ে তিস্তার জল নিয়ে চলে যাবে! মানব না।’
একইসঙ্গে ফরাক্কা চুক্তি পুনর্নবীকরণের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের একতরফা পদক্ষেপ বলেই তোপ দেগেছেন মমতা। তাঁর সাফ কথা, ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই কেন্দ্রের প্রতিনিধি। তাহলে ন্যায়বিচার মিলবে কীভাবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেটে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে বন্যা পরিস্থিতির জন্য বিপুল টাকা দিয়েছে কেন্দ্র। বাংলা বঞ্চিত কেন? বন্যার জন্য আমাদের রাজ্য বারবার ক্ষতির মুখে পড়ে।’ এই প্রসঙ্গেই তাঁর আশঙ্কা, ‘এবার দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনেরও বেসরকারিকরণ করে দেবে কেন্দ্র।’
একদিকে জল-সংঘাত, অন্যদিকে বাংলা ভাগের জন্য বিজেপির তোড়জোড়। মমতার গর্জন, ‘বাংলা ভাগের চক্রান্ত চলছে। ভোটের আগে বিজেপি যা করেছে, উত্তরবঙ্গে আসন পাওয়ার পরও তাই করছে। লজ্জার ব্যাপার। বিজেপির চারজন নেতা-মন্ত্রী চার রকম কথা বলছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথে আমরা বঙ্গভঙ্গ রুখবই। পারলে আসুন এই বিষয়ে বিধানসভায় ভোটাভুটি হোক। দেখি কী ফল হয়! যারা বাংলা ভাগ করতে চাইছে, মানুষ তাদের গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে শিক্ষা দেবে।’