• রাজনীতির ওঠাপড়ায় একদা শিষ্যের হাতেই এখন ক্ষমতা
    বর্তমান | ৩০ জুলাই ২০২৪
  • বিশ্বজিৎ মাইতি, বরানগর: ১৯৯৮ সাল। কামারহাটি জুটমিল সহ আশপাশের এলাকায় মাথা তুলছে নকশালরা। চটকল শ্রমিক মহল্লায় দ্রুত রাজনৈতিক জমি হারানো সিপিএমের তাবড় নেতারা মিছিল করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। ভাঙচুর হচ্ছে সিপিএম নেতাদের বাড়ি। পায়ের নীচের মাটি টিকিয়ে রাখার জন্য লালপার্টির নেতারা ‘বাহুবলী’দের সাহায্য পেতে পুলিসকে আসরে নামায়। দলবলের বহর, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তখন এলাকা কাঁপাচ্ছেন কামারহাটি জুটমিল লাগোয়া গলিঘাটের আনোয়ার আলি হোসেন। বাম নেতাদের  নজর পড়ে তাঁর উপর। লালপার্টির ছাড়পত্রে এলাকা সামলানোর অলিখিত স্বত্ব পেয়ে ‘আনোয়ার’ হয়ে ওঠেন এলাকার ত্রাস।


    কামারহাটির বাসিন্দারা জানেন, ক্ষমতার পালা বদলের গন্ধ পেয়েই নিজের সাম্রাজ্য রক্ষার তাগিদে একদা ‘গডফাদার’এর সঙ্গ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেন ক্ষুরধার বুদ্ধির আনোয়ার। কেমন ছিল সেই গ্যাং? টিটাগড়, ভাটপাড়া, জগদ্দল, হাজিনগর সহ বারাকপুর মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েকশো দুষ্কৃতীর ‘সেফ হাউস’ হয়ে উঠেছিল গলিঘাট। গোটা মহকুমার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আশ্রয় নিতে আসা দুষ্কৃতীদের রাখা হতো কামারহাটি পুরসভার দুই ও তিন নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন ক্লাব ও বাড়িতে। সেরকমই একজন সোমনাথ রায় চৌধুরি ওরফে বাবু মণ্ডল।  ট্রাক চালকের হাত ধরে ২০০০ সাল নাগাদ তিনি নদীয়া থেকে গলিঘাটের আনোয়ারের ডেরায় উঠেছিলেন। তুখোড় বুদ্ধিধর বাবু মণ্ডল দ্রুত গতিতে সামনের সারিতে উঠে আসেন। ঘনিষ্ঠ হন বাম নেতাদের। 


    আনোয়ারের গ্যাংয়ে অনেক পিছনের সারিতে ছিলেন আনিসুর রহমান ওরফে গুড্ডু। বাকিদের মতো তিনিও পেতেন মাস মাইনে। পালাবদলের পর শাসক দলের ছত্রছায়ায় গোড়ার দিকে ‘আনোয়ার গ্যাং’এর দাপট চলছিল একইভাবে। কিন্তু প্রভাবশালীরা চেয়েছিলেন, একচেটিয়া আধিপত্য রুখতে আনোয়ারের দল ভাঙিয়ে নতুন টিম তৈরি করতে। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির হাতছানিতে প্রথম বেরিয়ে আসেন বাবু মণ্ডল। কিন্তু ২০১৫ সালে মধ্যমগ্রামে জোড়া খুনের কাণ্ডে নাম জড়িয়ে গ্রেপ্তার হন বাবু।  ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিএম প্রার্থী মানস মুখোপাধ্যায়ের কাছে জেলবন্দি মদন মিত্র হারতেই বদলে যায় বাহুবলীদের সমীকরণ। উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় আনোয়ারের প্রভাব। এক প্রভাবশালী নেতার জেলজীবনে পাশে থেকে সেবাশুশ্রূষা করার প্রতিদান পান গুড্ডু। আনোয়ারের আধিপত্য খর্ব করে কামারহাটির নতুন ‘বস’ হয়ে ওঠেন। ২০২১ সাল থেকে তার প্রভাব চরমে ওঠে। শুধু তাই নয়, তিনি বর্তমানে আইএনটিটিইউসির কামারহাটির শহর সভাপতি। অন্যদিকে, জেল থেকে বেরিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে ঢোকার পরিকল্পনা নেন তুখোড় বক্তা বাবু। নেতাদের ভোট বৈতরণী পার করার নেপথ্য নায়ক ২০২২ সালে নিজেই নির্দল কাউন্সিলার হয়ে যান। শুধু তাই নয়, বারাকপুর মহকুমার মধ্যে সব থেকে বড় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা করে তিনি এখন ‘রথ বাবু’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। পুরাতন প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এখনও নির্দিষ্ট জায়গায় সাম্রাজ্য চালাচ্ছেন আনোয়ার ও বাবু। সতর্ক দৃষ্টি রেখে অপেক্ষা করছেন ‘মেন্টর’এর উত্থান-পতনের। যদিও সবার উপর ছড়ি ঘুরিয়ে প্রকৃত ‘রাজ’ চালাচ্ছেন গুড্ডু। এই পর্বে জয়ন্ত সিং’রা তো স্রেফ ছোট ছোট মনসবদার!


    আনোয়ার বলেন, পুলিসকে সহযোগিতা করেই নেশা মুক্ত সুস্থ সমাজ তৈরি করেছিলাম। বিনা পরিশ্রমের এক টাকা আমি খাইনি। এখন আমি নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। বাবু মণ্ডল বলেন, আমি আগে কী ছিলাম, এখন কী হয়েছি তা সকলে জানেন। পরমপিতা জগন্নাথ মহাপ্রভু যা চাইবেন, তাই হবে। গুড্ডুর কথায়, মানুষকে সেবা করার গুরুদায়িত্ব পালন করছি। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। সাংসদ সৌগত রায় বলেন, কামারহাটিতে আগের মতো অপরাধ হয় না। গুড্ডু  মানুষের কাজ করছে বলে জানি। ও দলের কোনও পদে আছে বলি জানি না। লালপার্টির প্রাক্তন বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, সিপিএম কোনওদিনও দুষ্কৃতীদের ব্যবহার করেনি। আমাদের সময় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে পুলিস কঠোর পদক্ষেপ নিত।
  • Link to this news (বর্তমান)