'এত সস্তা! আসুন না ভাগ করতে', ‘বঙ্গভঙ্গ’ নিয়ে সরব মুখ্যমন্ত্রী
এই সময় | ৩০ জুলাই ২০২৪
মণিপুস্পক সেনগুপ্ত
বিজেপির একাংশ যতই বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সওয়াল করুন না কেন, বাংলাকে তিনি কিছুতেই ভাগ হতে দেবেন না বলে সোমবার বিধানসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা, ‘আসুন না একবার বাংলা ভাগ করতে, এত সস্তা! দেখিয়ে দেবো কী করে রুখতে হয়।’গত এক সপ্তাহে বিজেপির বেশ কয়েকজন নেতা-বিধায়ক-সাংসদ নানা আঙ্গিকে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। বিধানসভায় হাজির হয়ে ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়ার চ্যালেঞ্জও তাঁদের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘যাঁরা বঙ্গভঙ্গের দাবি তুলছেন, তাঁদের কিছু বলার থাকলে বাংলার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বলুন। ভোটাভুটি হোক। কার পক্ষে ভোট বেশি পড়ে, কার পক্ষে ভোট কম পড়ে— তা গণতান্ত্রিক পথে বিচার হয়ে যাক।’
কিন্তু বিজেপির যাঁরা সে পথে না হেঁটে সাংবাদমাধ্যমে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সওয়াল করছেন, তাঁদের উদ্দেশে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, ‘বাংলার বিধানসভাকে বাদ দিয়ে যাঁরা বঙ্গভঙ্গের কথা বলছেন, তাঁরা সন্ত্রাসের দল। বিভাজনের দল। তাঁদের একটা কথাও আমি মানি না।’
যদিও এ দিন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আরও একবার দাবি করেছেন, বঙ্গভঙ্গ বিজেপির অ্যাজেন্ডা নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে। কখনও বলিনি রাজ্য ভাগ করতে হবে। তবে উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত।’ তাঁর প্রতিশ্রুতি, ‘আমরা ক্ষমতায় এলে উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য আলাদা প্যাকেজ দেবো।’
সম্প্রতি বালুরঘাটের সাংসদ তথা বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার উত্তরবঙ্গকে বাংলার মধ্যে রেখেই নর্থ-ইস্টে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে। তাঁকে সমর্থন জানান দার্জিলিংয়ের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তাও। এরপর দক্ষিণবঙ্গ ভাগের নতুন দাবি নিয়ে হাজির হন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। সংসদে তিনি দাবি তোলেন, বিহারের তিনটি জেলার সঙ্গে বাংলার মুর্শিদাবাদ, মালদাকে জুড়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করতে হবে।
তাঁর পাশে দাঁড়ান মুর্শিদাবাদ এবং বহরমপুরের বিজেপি বিধায়করা। সোমবার আবার নিশিকান্তের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী তথা বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর বলেন, ‘আমারও মনে হয়, মালদা-মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করলে ভালো হয়। কারণ, এটা ঠিক যে, ওই এলাকার জনবিন্যাস পাল্টে যাচ্ছে।’
বিজেপির একাংশের এই বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব যে শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হবে, সে বার্তা আগেই দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন বিধানসভায় বিজেপিকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি যতই বাংলাকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টা করুক, তিনি কিছুতেই তা বাস্তবায়িত হতে দেবেন না। তাঁর কথায়, ‘যেখান থেকে বিজেপি সব থেকে বেশি আসন জিতেছে, সেই উত্তরবঙ্গই বঞ্চিত হয়েছে কেন্দ্রীয় বাজেটে।’
এর পাশাপাশি রাজ্য সরকার উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্য কী কী করেছে, তার ফিরিস্তিও এদিন বিধানসভার ভাষণে উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর জমানায় উত্তরবঙ্গে কতগুলি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে— তার খতিয়ান তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, ‘ভোটের সময়ে বিজেপির শুধু বিভাজনের রাজনীতি! কেউ বলছেন, উত্তরবঙ্গকে আলাদা করে দিন। কেউ বলছেন, মালদা, মুর্শিদাবাদ ভেঙে দিন। কেউ আবার সংখ্যালঘুদের আলাদা করার কথা বলছেন। নির্বাচন এলেই ভাগাভাগি আর বিভেদের প্রশ্ন! নানারকম চক্রান্তের পরিকল্পনা চলছে। এ সব চলবে না। কোনও ভাগাভাগি হবে না বাংলায়।’
এ বারের লোকসভা ভোটেও উত্তরবঙ্গে আশানুরূপ ফল করতে পারেনি জোড়াফুল। কিন্তু তাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে চান না তৃণমূল সুপ্রিমো। রাজ্যভাগের দাবির বিরোধিতার পাশাপাশি তিনি যে উত্তরবঙ্গের মানুষের স্বার্থে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন, সে কথাও জোর গলায় দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়ার বিরোধিতা করে তিনি বিধানসভায় বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। কিন্তু মনে রাখবেন, তিস্তার জল ওদের দেওয়ার মতো অবস্থায় আমরা নেই। কারণ, তিস্তার জল বাংলাদেশকে দিলে উত্তরবঙ্গের মানুষ খাওয়ার জল পাবে না!’
তৃণমূলের ব্যাখ্যা, ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি মূলত বিভাজনের রাজনীতির উপরই বাজি ধরেছে। তাই দলের একাংশ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেও, অন্য একটি অংশ প্রকাশ্যেই বলছেন, ‘যে সম্প্রদায় আমাদের ভোট দেয়নি, আমরা তাদের দেখব না।’
মুখ্যমন্ত্রী সামগ্রিক ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ওঠা এই বিভাজনের রাজনীতিকে প্রতিহত করার ডাক দিয়ে বলেন, ‘যাঁরা আমাদের ভোট দেননি, তাঁরা বিপদে পড়লেও তাদের পাশে দাঁড়াব।’ বিজেপিকে খোঁচা দিয়ে তাঁর সংযোজন, ‘আমাদের স্লোগান একটাই হবে, আমরা তোমাদের চাই না। আমরা সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই।’