লিথিয়াম নিষ্কাশনের সহজ পথ বেরলো বঙ্গ-তনয়ার গবেষণায়
এই সময় | ৩১ জুলাই ২০২৪
এই সময়: ‘হোয়াইট গোল্ড’ বা সাদা সোনা! আগামী দিনে বিশ্বে পরিবেশবান্ধব শক্তির অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়াবে এটাই— যাকে আমরা চিনি লিথিয়াম হিসাবে। গোটা বিশ্বেই ক্রমাগত চাহিদা বাড়ছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ হোক বা গাড়ি, অথবা গ্রিড-স্কেল এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম— ভবিষ্যৎ হলো এই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিই।তবে এই ব্যাটারির মূল যে অংশ, সেই লিথিয়াম তো অফুরন্ত নয়। বিশেষ করে, যেখানে বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি বা ইভির চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে তো আগামী দিনে লিথিয়ামের ঘাটতি হতেই পারে। পরিসংখ্যান বলছে, আগামী আট বছরে বিশ্বে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির বাজার প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়বে। ফলে যেটা দরকার, সেটা হলো লিথিয়ামের বিকল্প উৎসের বন্দোবস্ত করা।
যদি ব্যবহার করা ব্যাটারি থেকেই আবার লিথিয়াম নিষ্কাশন করা যায়, তাহলে? ঠিক তারই উপায় বের করার চেষ্টা করছেন হিউস্টনের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক। পুলিকেল অজয়নের নেতৃত্বাধীন এই গবেষক দলে রয়েছেন বাংলার মেয়ে সোহিনী ভট্টাচার্য্য।
ওই গবেষক দলের একটি রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যাডভান্সড ফাংকশনাল মেটিরিয়ালস’-এ। ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্যাথোড থেকে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে খুব সহজেই কী ভাবে অন্তত ৫০ শতাংশ লিথিয়াম বের করা যায়, সেই পথই দেখিয়েছেন সোহিনীরা।
এমনিতে ব্যাটারি থেকে লিথিয়াম বের করার যে প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে, সেটা বেশ কঠিন। সেখানে বিভিন্ন কড়া অ্যাসিড ব্যবহার করতে হয়। বিকল্প পদ্ধতিতে তুলনায় পরিবেশবান্ধব ‘ডিপ ইউটেকটিক সলভেন্টস’ (ডিইএস) করলেই চলে। তাছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে মাত্র ৫ শতাংশের বেশি লিথিয়াম বের করা সম্ভব হয় না। কারণ, ফেলে দেওয়া ব্যাটারি থেকে শুধু লিথিয়াম নয়, কোবাল্ট, নিকেলের মতো ধাতুও নিষ্কাশন করা হয়।
অ্যাসিড ব্যবহার করলে এই পদ্ধতিতে সবার শেষে বের হয় লিথিয়াম, তবে ততক্ষণে ওই দ্রবণটি দূষিত হয়ে পড়ায় খুব সামান্য পরিমাণেই লিথিয়াম নিষ্কাশন সম্ভব। নতুন পদ্ধতিতে সেই বাধাও অনেকটা কেটে যাবে বলে আশা বিশেষজ্ঞদের।
এই গবেষক টিমের সদস্য সালমা আলহাসিমের বক্তব্য, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল, যাতে সরাসরি লিথিয়ামকেই আলাদা করে বের করা যায়। এজন্য আমরা যে ডিইএস কাজে লাগাচ্ছি, তাতে কোলিন ক্লোরাইড ও ইথিলিন গ্লাইকল-এর মিশ্রণ ব্যবহার করা হচ্ছে।’
কী ভাবে এটা এত সহজে শুধুমাত্র লিথিয়ামকে বের করে আনতে পারছে? সোহিনীর ব্যাখ্যা, ‘আমরা ডিইএস-এর সঙ্গে মাইক্রোওয়েভ টেকনোলজি ব্যবহার করে দেখতে পাই, ফেলে দেওয়া লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি থেকে লিথিয়াম নিষ্কাশনটা অনেক দ্রুততর হচ্ছে। এটা অনেকটা মাইক্রোওয়েভে রান্না করার মতো। মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করার সময়ে সেটা খুব তাড়াতাড়ি হয়, কারণ, সরাসরি খাবারের অণু বা মলিকিউলের মধ্যে তাপশক্তি পৌঁছে যায়। এক্ষেত্রেও সেটা হবে।’
গবেষকরা দেখেছেন, এই মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতিতে মিনিট পনেরোর মধ্যে অন্তত ৮৭ শতাংশ লিথিয়াম নিষ্কাশন সম্ভব হচ্ছে, যেখানে প্রচলিত অয়েল-বাথ হিটিংয়ে এই কাজটা করতেই অন্তত ১২ ঘণ্টা লাগছে।
কলকাতায় রুবি হাসপাতালের কাছে বাড়ি সোহিনীর। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে বেঙ্গালুরুর জওহরলাল নেহরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চ থেকে মেটিরিয়াল সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন সোহিনী। তারপরে পাড়ি দেন মার্কিন মুলুকে— হিউস্টনের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসাবে। বর্তমানে সেখানেই পোস্ট ডক্টরাল ফেলো তিনি।
মঙ্গলবার সেখান থেকে তিনি ‘এই সময়’কে বললেন, ‘এমনিতে কোবাল্ট, লিথিয়াম এই সব ধাতুগুলি সহজে পাওয়ার ক্ষেত্রে জিও-পলিটিক্যাল বাধা রয়েছে। লিথিয়াম যেমন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় চিলিতে। আমরা যে পদ্ধতিতে ফেলে দেওয়া ব্যাটারি থেকে লিথিয়াম নিষ্কাশনের পথ বের করেছি, সেটা একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিক ভাবে সাশ্রয়কর, তেমনই শিল্পবান্ধবও হবে বলে আমাদের আশা।’
তাঁর সংযোজন, ‘এবার কেন্দ্রীয় বাজেটেও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। সে দিক থেকে এই প্রক্রিয়ায় লিথিয়াম নিষ্কাশন করা হলে তা বিশ্ব তো বটেই, আমাদের দেশের কাছেও যথেষ্ট কার্যকরী হবে।’ আগামী দিনে ভারতে ফিরে দেশকে এনার্জি ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী করতে কাজ করতে চান সোহিনী।