ভেড়ি-কমিশন না দেওয়ার শাস্তি ব্যবসায়ীকে বাড়িছাড়া করল বিজেপি
বর্তমান | ০১ আগস্ট ২০২৪
শ্রীকান্ত পড়্যা, নন্দকুমার: নন্দকুমার থানা থেকে ৭০০ মিটার দূরে দ্বারিয়াপুর গ্রাম। অথচ, এই গ্রামে আইনের শাসন চলে না। গ্রামে বিজেপির মাতব্বরদের আইন এখানে শেষ কথা। ওই মাতব্বরদের ফতোয়ায় সাত মাস সপরিবারে বাড়িছাড়া অসিতকুমার মাইতি। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সাত মাস তালাবন্ধ বাড়ির সামনে দু’টি বড় ফ্লেক্স ঝুলছে। তাতে লেখা, ‘অসিতকুমার মাইতির ঘরবাড়ি, স্থাবর, অস্থাবর কোনওকিছু ক্রয়-বিক্রয়, দান ও হস্তান্তর করা যাবে না।
গ্রামে ভেড়ি বানিয়ে মাছ চাষ করতে হলে লিজ নেওয়া জমি থেকে বছরে বিঘা প্রতি দু’হাজার টাকা গ্রাম কমিটিতে দিতে হয়। ভেড়ির জমি নিজের হলে টাকার পরিমাণ কমে হয় এক হাজার। মোদ্দা কথা, গ্রাম কমিটিকে দক্ষিণা না দিয়ে গ্রামে মাছচাষ করা যাবে না। অসিতকুমার মাইতি স্থানীয় বেশ কয়েকজনের থেকে লিজে জমি নিয়ে ভেড়িতে মাছ চাষ করতেন। সেই সুবাদে অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হয়। দ্বারিয়াপুর গ্রামে সাজানো গোছানো একতলা পাকা বাড়ি। বাড়িতে এসি, সিসি ক্যামেরা সবই রয়েছে। কিন্তু, গ্রাম কমিটিকে কমিশন দেওয়া নিয়ে তাঁর সঙ্গে সংঘাতের সূত্রপাত। তিনি টানা তিন বছর গ্রাম কমিটিকে তাদের নির্ধারিত টাকা দেননি। এটাই তাঁর অপরাধ।
দ্বারিয়াপুর গ্রাম কমিটির সভাপতি রাম মাইতি এবং সম্পাদক ভরত কুইল্যা বিজেপি করেন। ২০২৩ সালে ওই গ্রাম থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বিজেপির মল্লিকা ঢালি জানা। স্থানীয় কল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতও বিজেপির দখলে। বিজেপি গ্রাম পঞ্চায়েত জেতার পর গ্রাম কমিটির খবরদারি কয়েকগুণ বেড়েছে। ভেড়ি থেকে পাওনা টাকা না পেয়ে গ্রাম কমিটির মাতব্বররা অসিতকুমার মাইতিকে নিয়ে সালিশিতে বসে। সেখানে মোটা অঙ্কের জরিমানা চাপিয়ে তাঁকে টাকা দিতে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু, অত টাকা তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় বলে অসিতবাবু জানান। এরপরই তাঁকে একঘরে করে দেওয়া হয়।
২০২৩ সালের ২৭সেপ্টেম্বর গ্রাম কমিটির মাতব্বররা অসিতবাবুর বাড়িতে চড়াও হন। সস্ত্রীক তাঁকে নিগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ। এরপর মাতব্বরদের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করেন অসিতকুমার মাইতি। এটাই তাঁর জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রাম কমিটি ওই মাছ ব্যবসায়ীকে গ্রামছাড়া করার ফতোয়া দেয়। শেষ পর্যন্ত মাতব্বরদের চাপে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে নিজের বাস্তু ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন অসিতবাবু। এখন তিনি দ্বারিয়াপুর গ্রামে বসবাস করেন না। বাড়ির সামনে বড় লোহার গেট। সেই গেটে তালা ঝুলছে। আর দু’পাশে দু’টি বড় ফ্লেক্স ঝুলছে।
এই কল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে সোন্দলপুর গ্রাম পড়ে। সেখানেও গ্রাম কমিটির মাতব্বররা ভেড়ির টাকা না পেয়ে ১৯টি পরিবারকে সামাজিক বয়কট করে রেখেছে।
এনিয়ে প্রশাসন কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে। সাত দিনের মধ্যে বয়কট না তুললে মাতব্বরদের গ্রেপ্তারের হুঁশিয়ারি দিয়েছে পুলিস। একই গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে দ্বারিয়াপুর গ্রামে আস্ত একটা পরিবারকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে গ্রাম কমিটি। তাও পরিবারটি থানা থেকে সাতশো মিটার দূরে।
গ্রাম কমিটির সভাপতি রাম মাইতি বলেন, অসিত ভেড়িতে মাছচাষ করলেও গ্রাম কমিটির ধার্য করা টাকা দেননি। তাছাড়া, যে সকল চাষির থেকে জমি লিজে নিয়েছিলেন, তাঁদেরও টাকা দেননি। তাঁকে এনিয়ে চাপ দেওয়া হয়েছিল। তারপর বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যা মল্লিকাদেবী বলেন, এটি গ্রাম কমিটি করেছে। এরসঙ্গে পঞ্চায়েতের কোনও যোগ নেই। নন্দকুমার থানার ওসি উজ্জ্বল নস্কর বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। নিজস্ব চিত্র