• দিনমজুরের ছেলে অভিজিৎ ভর্তি হলো IIT ভুবনেশ্বরে
    এই সময় | ০১ আগস্ট ২০২৪
  • সমীর মণ্ডল, মেদিনীপুর

    মাধ্যমিক পর্যন্ত জানাই ছিল না, আইআইটি কী, সেখানে ঠিক কী পড়ানো হয়! দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে চলছিল পড়াশোনা, ফুটবল খেলাও। তবে পড়াশোনা নয়, স্কুল বদলানো ফুটবলের জন্য। সেই স্কুলের শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য-নজরদারি এবং নিজের অদম্য ইচ্ছের জোরে দিনমজুরের ছেলে জঙ্গলমহলের অভিজিৎ মাঝি ভর্তি হয়েছে আইআইটি ভুবনেশ্বরে।পশ্চিম মেদিনীপুরের গুড়গুড়িপাল থানার কঙ্কাবতী গ্রামের বাসিন্দা অভিজিৎ নিজের গ্রামের স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত ফুটবল খেলত। ২০১৯ সালে খেলা প্রসঙ্গেই তার কথা সবংয়ের দশগ্রাম সতীশচন্দ্র সর্বার্থসাধক শিক্ষাসদনের প্রধান শিক্ষক যুগল প্রধানকে বলেছিলেন এক ফুটবল কোচ। সে বার সুব্রত কাপ খেলতে যাওয়ার কথা দশগ্রাম স্কুলের।

    প্রধান শিক্ষক প্রস্তাব দেন, অভিজিৎ যদি তাঁর স্কুলে ভর্তি হয়, তবেই একমাত্র সুব্রত কাপ খেলতে যেতে পারবে। সেই মতোই ক্লাস এইটে মাঝপথে গ্রামের স্কুল ছেড়ে দশগ্রাম স্কুলে ভর্তি হয় অভিজিৎ। স্কুলের হয়ে সুব্রত কাপ খেলতেও যায় সে। খেলার পাশাপাশি অভিজিৎ যে পড়াশোনাতেও তুখোড়, তা নজর এড়ায়নি প্রধান শিক্ষকের। তাই গাইড করেছেন নিয়মিত।

    ২০২১ সালে মাধ্যমিকে স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ (৬৬৪) নম্বর পায় সে। পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এগিয়ে আসে স্কুলের ট্রাস্ট। স্কুলের হস্টেলেই অভিজিতের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পড়াশোনার খরচেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। এ বছর সেই স্কুল থেকেই ৪৫১ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সে।

    দু’বছর আগে যে ছেলেটা আইআইটি সম্পর্কে জানত না, তার মনে ততদিনে দানা বেঁধেছে ভালো কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন। স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতায় চেষ্টাও চালিয়ে যায় অভিজিৎ। অবশেষে মঙ্গলবার আইআইটি ভুবনেশ্বরে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছে সে।

    স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘২০১৯ সালে আমাদের স্কুল সুব্রত কাপ খেলতে যাওয়ার আগে অভিজিৎ ক্লাস এইটে ভর্তি হয়। ভালো ফুটবল খেলে, পড়াশোনাতেও ভালো। পারিবারিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ক্লাস টেন পর্যন্ত হস্টেল-স্কুলের খরচের ব্যবস্থা করে দিই। মাধ্যমিকে স্কুলে হায়েস্ট নম্বর ছিল ওর। ক্লাস ইলেভেন থেকে আমাদের স্কুলের ‘কাজলবাবু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ ওর পড়াশোনায় নানা ভাবে সাহায্য করে।

    ট্রাস্টের সভাপতি প্রাক্তন শিক্ষক দীপক পট্টনায়ক এ সব বিষয়ে খুবই হেল্পফুল। মাঝে মধ্যে নিজে বায়োলজি পড়িয়েছেন। এছাড়া পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক রণজিৎবাবু, অঙ্কের শিক্ষক মলয়বাবুও পড়াশোনায় সাহায্য করেছেন। আমাদের স্কুলের প্রাক্তনী ট্রাস্টের সদস্য ডক্টর নিরঞ্জন শীট অর্থ দিয়ে, অনলাইনে পড়াশোনার জন্য ট্যাব কিনে দিয়ে অভিজিতের লেখাপড়ায় সাহায্য করেছেন। অভিজিৎ আইআইটি ভুবনেশ্বরে ভর্তি হয়েছে। আমরা ওর সাফল্য কামনা করি। ও আরও এগিয়ে যাক।’

    অভিজিতের বাবা সুকুমার মাঝি পোল্ট্রি ফার্মের লেবার। মা কাঞ্চনী মাঝি মাঝেসাঝে চাষের কাজে মজুর খাটেন। মা বলেন, ‘আমরা নিজেরা লেখাপড়া জানি না। তাই ছেলেদের পড়াতে চেয়েছি বরাবর। কিন্তু ওর বাবা আর একা সংসার টানতে পারছিল না।

    তাই বড় ছেলে বিশ্বজিৎ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে পলিটেকনিক ডিপ্লোমা মাঝ পথে ছেড়ে ডাকবিভাগের চাকরিতে ঢুকে যায় দু’বছর আগে। মেজ ছেলে শুভজিৎ মেদিনীপুর আইটিআই-তে কারিগরি বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করছে। আর ছোট ছেলে অভিজিতের খেলা দেখে দশগ্রাম স্কুলের শিক্ষকরা ওঁদের স্কুলে ভর্তি নিয়ে নেন। ওঁদের মতো লোকজন না থাকলে আমার ছেলে এত বড় জায়গায় পড়ার সুযোগ পেত না।’

    ভুবনেশ্বর থেকে অভিজিৎ ফোনে বলে, ‘স্কুলের প্রধান শিক্ষক যুগলবাবু, কাজলবাবু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সভাপতি দীপকবাবু, স্কুলের প্রাক্তনী নিরঞ্জনবাবু এবং স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্য ছাড়া আমি এই জায়গায় আসতে পারতাম না। আমি যদি কোনও দিন প্রতিষ্ঠিত হতে পারি, তাহলে ওই স্কুলের জন্য, কাজলবাবু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব। যাতে আরও অনেক দুঃস্থ ছেলে পড়ার সুযোগ পায়।’
  • Link to this news (এই সময়)