• পূর্ব বর্ধমানে জলের তলায় একাধিক গ্রাম, ভাঙ্গল ঘরবাড়ি, ত্রাণ শিবিরে সরানো হল বন্যা দুর্গতদের
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০২ আগস্ট ২০২৪
  • বন্যায় খোলা হল কন্ট্রোল রুম

    আমিনুর রহমান, বর্ধমান, ২ আগষ্ট: বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শুক্রবার একটানা লাগাতার ভারী বৃষ্টিতে সারা পূর্ব বর্ধমান জেলার গ্রাম ও শহরে জনজীবন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বন্যার কবলে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষজন। জলমগ্ন হয়ে পড়ে কালনা, কাটোয়া, গুসকরা শহর সহ একাধিক গ্রাম। বর্ধমান পৌরসভার নিচু এলাকাগুলো জলে ডুবে গিয়েছে। বিভিন্ন রাস্তায় জল জমে যায়। যাতায়াতে হয়রানির শিকার হতে হয় পথচারি ও এলাকার বাসিন্দাদের। অন্যদিকে জামালপুরের আঝাপুর অঞ্চলে ক্যানেলের বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে জল ঢোকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। একই অবস্থা কালনা মহকুমার নাদনঘাটে। সেখানে খড়ি নদীর পাড়ে ধস নামার ফলে লাগোয়া গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। শহর বর্ধমানের অদূরে রায়ান, উদয়পল্লী, কাঞ্চননগর সহ নিচু এলাকার একাধিক গ্রাম পুরোপুরি জলের তলায়। গুসকরা পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ডে জল জমে আছে। গ্রাম গুলোতে ঘরবাড়ি, দোকানে জল ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।

    একদিকে ডিভিসি জলাধার থেকে জল, অন্যদিকে বৃষ্টির জলে গ্রামগুলোর মাঠঘাট টইটুম্বুর। চাষের কাজে উঁচু এলাকায় কিছুটা হলেও সুবিধা হলেও কৃষি প্রধান পূর্ব বর্ধমানের ধান চাষে আবারও চরম সংকটে পড়লেন চাষিরা। কারণ, বেশির ভাগ চাষের জমিতে বীজতলা সম্পূর্ণভাবে জলের তলায়। এদিকে আংশিক বন্যার আশঙ্কায় শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসনের তরফে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ শিবির খুলে সাধারণ মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে আনার কাজ শুরু হয়।

    বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে। শুক্রবারও দিনভর বৃষ্টি থামেনি। একটানা ২৪ ঘন্টার বেশি ভারী বর্ষণের ফলে বিভিন্ন গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। জলের অভাবে যেখানে ধান চাষে সংকট ছিল, সেই কৃষি জমি এখন কার্যত জলের তলায়। এরই মধ্যে ২৭ জুলাই থেকে ডিভিসি জল ছাড়ার পর ক্যানেলগুলোতে জল ছাপিয়ে যাবার অবস্থা দেখা দিয়েছে। রায়ান গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু চাষি বিশ্বেশ্বর চৌধুরী জানান, যেভাবে মাঠঘাট জলে ডুবেছে, তাতে আবার নতুন করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। আর এজন্য আরও প্রায় পনেরো দিন পিছিয়ে গেল চাষ। এর ফলে এবার ধানের ফলন নিয়ে চাষিদের মাথায় হাত পড়বে। একই সঙ্গে গ্রামের পুকুরগুলো যেভাবে জলে ভরে গেছে, তাতে মাছ চাষিরাও চরম বিপদে পড়তে চলেছেন বলে তাঁর দাবি। এর মধ্যে জামালপুর ব্লকের আঝাপুরে ক্যানেলের বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দাসপাড়া এলাকায়। গ্রামবাসীদের দাবি ফাটল দিয়ে জল ঢুকছিল।

    তবে জামালপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মেহেমুদ খান বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেই ফাটল মেরামত করা হয়। আর কোনও ভয় নেই। তিনি জানান, শুক্রবার ব্লকের সব অঞ্চলে ঘুরে দেখা হয়। সঙ্গে ছিলেন বিডিও পার্থ সারথি দে এবং পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ভূতনাথ মালিক। তবে জামালপুর ? ২ ব্লকের দু একটি গ্রাম ডুবে যাওয়ার ফলে বহু পরিবারকে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের হাতে শুকনো খাবার ও ত্রিপল তুলে দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুক্রবার সকাল থেকেই খাবার, ত্রিপল দেওয়া হয়েছে। অতি বৃষ্টির ফলে কালনার নাদনঘাটে খড়ি নদীর পাড়ে ধস নেমেছে। আশপাশের গ্রামবাসীরা আতঙ্কে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন বৃহস্পতিবার রাতে। যাঁরা রয়েছেন তাঁরা প্রশাসনের কাছে পুনর্বাসনের দাবি করেছেন। অবিরাম বৃষ্টিতে মেমারি ব্লকের পাড়হাটি সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম জলমগ্ন বলে জানা গিয়েছে। বেশিরভাগ রাস্তায় হাঁটু জল। কাটোয়া শহরের অদূরে একটি সেতু পুরোপুরি জলের তলায় চলে যাওয়াতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শহরেও জনজীবন বিপর্যস্ত।

    একটানা বৃষ্টির ফলে কালনা শহরে জনজীবন বিপন্ন। বিভিন্ন স্থানে জল জমে আছে। কালনা শহরের একদিক দিয়ে ভাগীরথী নদী বয়ে গিয়েছে। ফলে শহরের বড় অংশের বৃষ্টির জমা জল ভাগীরথীর দিকে না গিয়ে রেললাইনের দিকে যায়। নিকাশি নালায় প্লাস্টিক ও আবর্জনা জমে থাকায় বৃষ্টিতে জলনিকাশি ঠিকমতো হয়নি। বিভিন্ন জায়গা ও রাস্তায় জল জমে সমস্যায় পড়েছেন এলাকার বাসিন্দা থেকে পথচারীরা। আমলাপুকুর, কাঁসারিপাড়া, যোগীপাড়া, শাসপুর সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় জল জমে যায়। নসরৎপুর এলাকায় চড়গোয়ালপাড়া, খামারডাঙ্গাতে বাড়ি-ঘর সবই জলের তলায়। বেশিরভাগ এলাকায় জাঁক দেবার জন্য রাখা পাট জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে। পৌরসভার কাউন্সিলার অনিল বসু বলেন, শহরের অধিকাংশ জল ভাগীরথীর দিকে না গিয়ে উল্টোদিয়ে যায়। রেললাইনের নীচ দিয়ে নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় শহরের জল বের হতে কিছুটা সময় লাগে।

    এদিন দিনভর বৃষ্টির মধ্যে সাফাইকর্মীরা নিকাশি নালাগুলি পরিষ্কারের কাজ চালিয়ে যান। এদিন পূর্বস্থলী-১ ব্লকের নসরৎপুর পঞ্চায়েতের খড়ি নদীর তীরবর্তী গোপীনাথপুরে বেশ কয়েকটি বাড়ির পাশের রাস্তায় ধস নামে। ভেঙে যায় রাস্তা। মানুষজন ভয়ে ও আতঙ্কে বৃহস্পতিবার রাতেই ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই চলে গেছেন। প্রশাসনের কাছে পুনর্বাসনের দাবি করেন তাঁরা। নান্দাই স্টেশন সংলগ্ন রেলের আন্ডারপাসে হাঁটু পর্যন্ত জল জমে যায়। যাতায়াতে হয়রানির শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষকে। নাগাড়ে বৃষ্টির জন্য গুসকরা পৌরসভার সাতটি ওয়ার্ড সম্পূর্ণভাবে জলের তলায় চলে যায়। একতলা বাড়িতে জল ঢুকে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষজন। অতি ভারী বৃষ্টিতে বর্ধমান পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ডে জমা জলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ছোটনীলপুর, লক্ষীপুরমাঠ এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে জল ঢুকতে শুরু করে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বর্ধমান ? ১ ব্লকের কয়েকটি গ্রামের লোকজনকে ত্রাণ শিবিরে এনে রাখা হয়েছে। যেসব গ্রামে মাটির বাড়ি ধসে গেছে, আপাতত তাঁদের ত্রিপল ও খাবার দেওয়া হয়েছে।

  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)