ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: মাঝে ৩০ বছরের ব্যবধান। তাতেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। তৃণমূলের বক্তব্য, বহরমপুরে যে পথে ‘গুরু মেরেছিলেন’ অধীর চৌধুরী, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে সেই পথেই ধরাশায়ী করা হয়েছে। অধীরকে এআইসিসি ‘প্রাক্তন’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যেই তৃণমূল ফাঁস করল বহরমপুরে অধীর চৌধুরীকে হারানোর ফর্মুলা।
কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃত্ব যাঁদের অনেকেই এখন তৃণমূলে, তাঁদের দাবি, ১৯৯৪-এর লোকসভা উপনির্বাচনে কংগ্রেস সংখ্যালঘু একজনকে প্রার্থী করে। উপনির্বাচন বলে সেভাবে খাটাখাটনি করেনি। তাতেও বিপুল সংখ্যালঘু ভোট টেনে দ্বিতীয় হন তৎকালীন জেলা সভাপতি অতীশ সিনহার প্রার্থী নুরে আলম চৌধুরী। আরএসপির প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়ের কাছে তিনি হেরেছিলেন ৩২ হাজার ভোটে। এই নুরে আলম সম্পর্কে রেজিনগরের বর্তমান বিধায়ক রবিউল আলম চৌধুরীর কাকা। এতে দুটো জিনিস সামনে আসে। এক, কংগ্রেস নেতৃত্বের বিশ্বাস হয় যদি কখনও কোনও বড় দল সেখানে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়ে একটু পরিশ্রম করে তাতে সে জিতবেই। আর দুই, নুরের জন্য জেলা নেতৃত্ব সেভাবে না খাটলেও অভিযোগ ওঠে অধীর চৌধুরী তাঁকে হারিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এই অঙ্কই বহরমপুরে চব্বিশের প্রার্থী চয়নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে রেখেছিল জেলা তৃণমূল। অধীর সম্পর্কে আরও দু-একটি তথ্য দেওয়া হয়। তৃণমূলের দাবি, অধীর বরাবর নিজস্ব ক্যারিশমায় জিতলেও তাঁর জয়ের ‘প্রাণভ্রমরা’ আসলে বিজেপির ঘরে থাকত। সংসদীয় রাজনীতির শুরু থেকেই বহরমপুর কেন্দ্রে তাঁর ভোট বেড়েছে আর বিজেপির ভোট কমেছে। তাংর বিরুদ্ধে বিজেপির সঙ্গে অঘোষিত আঁতাতের অভিযোগ তৃণমূলের বরাবরের। এই কৌশলেই হিন্দু আর মুসলমান ভোট মিলিয়ে অধীর প্রত্যেকবার নিশ্চিন্তে জিতে যেতেন বলে দাবি শাসকদলের। বহরমপুরে সংখ্যালঘু ভোট ৫৫ শতাংশ, বাকিটা হিন্দু ভোট। তৃণমূলের বক্তব্য, অধীরবাবু বারবার বলেন সংখ্যালঘু অঙ্কে ভোট করেছে তৃণমূল। কিন্তু তা নয়। অঙ্ক কষে শুধু বিজেপির ভোটটা আটকে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল।
১৯৯১ আর ১৯৯৬-এ নবগ্রাম বিধানসভার ফল বিশ্লেষণ করা হয় রাজ্য নেতৃত্বের সামনে। ’৯১ সালে নবগ্রামে ২ হাজার ভোটে সিপিএমের কাছে হারেন অধীর। সিপিএম পায় ৫১ হাজার ভোট। অধীর ৪৯ হাজার। বিজেপি পেয়েছিল ৮ হাজারের কিছু বেশি। ’৯৬ সালের ভোটে অধীর ৭৬ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হন। সিপিএম পায় ৫৬ হাজার ভোট। সেবার এক রিকশাচালককে বিজেপি প্রার্থী করেছিল, যিনি পেয়েছিলেন মাত্র ২ হাজার ভোট। আগের তুলনায় যা ৬ হাজার কম। জেলা তৃণমূলের দাবি, এই রিকশাচালক প্রার্থী বিজেপিকে জোগাড় করে দিয়েছিলেন অধীরই। বিজেপির ভোট নিজের দিকে টানতেই এই কৌশল ছিল তাঁর। লালগোলার তৃণমূল বিধায়ক মহম্মদ আলির কথায়, “৯৬-এ সিপিএমের ভোট বেড়েছিল, অধীর চৌধুরীও বেশি ভোট পান। কিন্তু বিজেপির ভোট শিফট হয়ে যায় অধীর চৌধুরীর দিকে। এটা তাঁর জয়ের কৌশলের ট্রেন্ড হয়ে যায়। অধীরবাবুর ভোট যত বাড়ে, বিজেপির ভোট তত কমে। শুধু ২০১৪ সালে মোদি-জোয়ারে বিজেপির ভোট বেড়েছিল।” ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীরের কথায়, “৯৪-এর ভোটে কীভাবে অধীর চৌধুরী কংগ্রেসকে হারিয়েছিলেন তার সাক্ষী আমি। কংগ্রেসের ভোট সেবার আমিই করিয়েছিলাম। জেলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনক ছিলেন অধীরবাবুই। সমস্ত তথ্য দলকে জানিয়েছিলাম।”
তবে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের বক্তব্য, তাঁরা কেউই ভাবতে পারেননি যে ইউসুফ পাঠানের মতো এমন হেভিওয়েটকে প্রার্থী করবে দল। সেটা ছিল চমক। শাসকদলের বক্তব্য, অধীর যে বিজেপির ভোটের জোরে বারবার জিততেন তৃণমূলের লক্ষ্য ছিল ইউসুফের মতো জাতীয় স্তরে জনপ্রিয় কাউকে প্রার্থী করে সেই ভোটটা আটকানো। অধীরকে হারানোর জন্য এত অঙ্ক কষার চ্যালেঞ্জ তৃণমূলের সামনে এনে দিয়েছিলেন অধীর নিজেই। বহরমপুরের সাংগঠনিক সভাপতি কান্দির বিধায়ক অপূর্ব সরকারের কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছিলেন অধীরবাবু। কথাটা ভীষণ গায়ে লাগছিল। ব্যক্তিগত জেদ হিসাবে নিয়েছিলাম। কারণ, আমরা জানি, আর তার তথ্যপ্রমাণও আছে যে, বরাবর ভোটের খেলা ঘোরাতে বিজেপির ভোট নিজের দিকে টানার ব্যবস্থা করে নিতেন অধীর। সেটাই ছিল তাঁর নিশ্চিত জয়ের কৌশল।”