• বাঘের থাবায় আহত হরিপদ, এক মাসে পাঁচটি অপারেশন
    এই সময় | ০৩ আগস্ট ২০২৪
  • সুনন্দ ঘোষ

    কথায় বলে বাঘে ছুঁলে নাকি আঠারো ঘা। এ তো শুধু ছোঁয়া নয়। থাবার আঘাতের সঙ্গে যোগ হয়েছে কামড়ও। তবু মৃত্যু ছুঁতে পারেনি ৩৫ বছরের হরিপদ দাসকে। এসএসকেএম-এর প্লাস্টিক সার্জারির প্রধান ডক্টর অরিন্দম সরকার বোঝাচ্ছিলেন, ‘নতুন দইয়ের হাঁড়ি থেকে যে ভাবে হাতা দিয়ে দই কেটে নেওয়া হয়, অনেকটা সে ভাবেই মাথার পিছন থেকে ডান দিকের গলা পর্যন্ত চেঁছে নিয়েছে বাঘ।’৩ জুলাই সুন্দরবনের মাতলা নদীর উপরে নৌকোয় হরিপদর সঙ্গে ছিলেন শ্রীদাম মণ্ডল ও প্রতীপ নস্কর। ফোনে শ্রীদাম বলেন, ‘মাতলার উপরে ডাঙা থেকে প্রায় ১৫ ফুট ভিতরে ছিলাম। নৌকো নোঙর করে জাল ফেলে মাছ ধরছিলাম। সকাল তখন প্রায় ১০টা হবে। আমাদের মুখ ছিল মাতলার দিকে। পিছন দিক থেকে আচমকাই হানা দেয় বাঘ। ডাঙা থেকে লাফ মেরে উড়ন্ত অবস্থাতেই হরিপদর মাথায় থাবা দিয়ে মুখে কামড় মারার চেষ্টা করে। ঝটকা মারে হরিপদ। টাল খেয়ে যায় নৌকো।’

    বলে চলেন শ্রীদাম, ‘বাঘ সম্ভবত দূরত্বটা ঠিক মতো আন্দাজ করতে পারেনি। তাই, লাফটা একটু বড়ই দিয়ে ফেলেছিল। সে যদি নৌকোয় পড়ত, আমাদের তিনজনকেই সাবাড় করে দিত। কিন্তু, সে লাফ দিয়ে নৌকো থেকে প্রায় পাঁচ ফুট উপর দিয়ে উড়ে যায়। ওই যাওয়ার সময়েই হরিপদকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু, পারেনি। হরিপদর ঝটকা আর নিজের গতিবেগে সে গিয়ে পড়ে নৌকো ছাড়িয়ে মাতলার জলে।’

    এখানেই গল্পের শেষ নয়। শিকার ফসকে মাতলার জলে পড়ে, মুখ ঘুরিয়ে আবার সাঁতরে নৌকোর দিকে আসতে শুরু করে বাঘ। বাঘের চাপড় খেয়ে ততক্ষণে হরিপদও নৌকোর অন্য পাশে জলে পড়ে গিয়েছিলেন। শ্রীদামের কথায়, ‘আমরা দু’জনে ওকে টেনে তুলি। নৌকো ছেড়ে দিই মাঝ নদীর দিকে। বাঘ সাঁতরে ডাঙায় উঠে আমাদের পিছু নেয়। আমরা জলে জলে চলছিলাম, আর আমাদের দেখতে দেখতে বাঘ ডাঙায় ডাঙায় চলছিল। কতক্ষণ জানি না। তবে, বেশ কিছুক্ষণ পরে হাল ছেড়ে সে জঙ্গলে ঢুকে যায়। রক্তাক্ত হরিপদকে ওই অবস্থায় নৌকোয় শুইয়ে আমরা প্রায় দু’ঘণ্টা নদীতে নৌকো চালিয়ে কৈখালি আশ্রমের কাছের ঘাটে হরিপদকে নামাই।’

    ডাক্তারের মতে, বেশিরভাগ মানুষই এরকম অবস্থায় ‘শক’-এ চলে যায়। বহু ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টও হয়ে যায়। হরিপদর লড়াই জারি রয়েছে। ২৯ জুলাই বিশ্ব ব্যঘ্র দিবসের দিন তিনেক আগে পাঁচ নম্বর অপারেশনে তাঁর কপাল থেকে মাংস ও চামড়া নিয়ে চোখের তলায় বসানো হয়েছে।

    ‘মেজর অপারেশন এখনও বাকি। মাথার পিছনের হাড় বেরিয়ে রয়েছে’— বলছিলেন, প্লাস্টিক সার্জেন মনোরঞ্জন শো। তাঁর কথায়, ‘বড়সড় চেহারা আর অফুরান প্রাণশক্তিই বাঁচিয়ে দিয়েছে তাঁকে।’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির গোপালগঞ্জের রামপুরগ্রামে স্ত্রী ও দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে সংসার হরিপদর। পেশায় মৎস্যজীবী। নৌকো নিয়ে সুন্দরবনের খাড়ি-সে খাড়িতে মাছের আশায় ঘুরে বেড়ান।

    জয়নগর রুরাল হাসপাতাল ঘুরে সে দিনই গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে নিয়ে আসা হয় এসএসকেএম-এ। শ্বাসনালী ছিঁড়ে সেখান দিয়ে রক্ত ঢুকছিল ফুসফুসে। ডক্টর অরিন্দম জানিয়েছেন, মাথার খুলি-মুখের ডান দিক-ঘাড়ের পিছনে বড়সড় ইনজুরি ছিল। চোখ দু’টো বেঁচে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ওটিতে নিয়ে গিয়ে ট্র্যাকিওস্টমি করা হয়। এখনও ওই অবস্থায় আছেন হরিপদ।

    অরিন্দমের কথায়, ‘ডান দিকের নীচের চোয়াল নেই। বাঘে খুবলে নিয়ে গিয়েছে। ডান দিকের উপরের চোয়াল এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে তা-ও বাদ দিতে হয়েছে।’ ৩ জুলাইয়ের পরে ৬, ১২, ১৯ ও ২৬ জুলাই কখনও চোয়াল বাদ দিতে, কখনও বুক থেকে মাংস নিয়ে মুখ ও গলার রি-কন্সট্রাকশান করতে ডক্টর তিবর বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে একের পর এক ওটি করেছেন অরিন্দম ও মনোরঞ্জন।

    কথা একদমই বলতে পারছেন না হরিপদ। রাইলস টিউবে খাওয়ানো হচ্ছে। যদিও জ্ঞান রয়েছে টনটনে। ব্যথা, খিদে, বা ঘুমের ব্যাঘাত হলে তা লিখে জানাচ্ছেন ডাক্তারদের। হাসপাতালের ডিরেক্টর মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘অমন একটা তরতাজা যুবককে বাঁচানোই ছিল আমাদের প্রাইওরিটি।’

    আপাতত আরও সপ্তাহ তিনেক থাকতে হবে হাসপাতালে। পরে চোয়াল বসাতে আবার আসতে হবে। তারও পরে সুন্দরবনের খাড়িতে নকল চোয়াল শক্ত করে আবার জাল হাতে দেখা যাবে তাঁকে।
  • Link to this news (এই সময়)