রাজনৈতিক পথটা ছিল বহু আন্দোলন, বিরোধিতা আর অনেকখানি সৌজন্য মেশানো। প্রতিপক্ষই হোক, দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ একসঙ্গে পেরিয়েছিলেন তাঁরা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসানে উদ্বেগ চেপে রাখতে পারেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আচমকা এই দুঃসংবাদে ‘টেনসড’ হয়ে পড়েন তিনি। হাত ঘষে যায়, রক্তও বার হয়। ব্যান্ডেজ বেঁধেই তিনি ছুটে যান বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে। স্মৃতিতে বহু টুকরো চিত্র। ভারাক্রান্ত গলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘অনেক কথা আজ বলব না। আজ তাঁর পরিবার-পরিজনের পাশে থাকার দিন’। লাল,সবুজ রাজনীতি, আন্দোলনের বাইরে এ এক অন্য ক্ষণ। প্রতিপক্ষকে চিরতরে হারানোর কঠিন মুহূর্ত।রাজনীতিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবর বিপরীত মেরুতে থেকেছেন। রাজনৈতিক মত-পথ একেবারে আলাদা। বহুবার বহু মঞ্চ, সভা, মহাকরণের অন্দরের ক্ষমতা বদলে তা সামনে এসেছে। কিন্তু, রাজনীতির বাইরের পরিসরে সৌজন্যের কাপর্ণ্য ছিল না কোনও তরফেই। বছরখানেক আগের কথা, আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নবান্ন থেকে বেরিয়ে বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয় ছুটেছিল বালিগঞ্জের দিকে। তিনি পাম অ্যাভিনিউয়ের দিকে টার্ন নিতেই বঙ্গ রাজনীতিতে তুমুল শোরগোল পড়েছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী! হ্যাঁ বাংলাতেই সম্ভব, বিরোধী সম্পর্কেও আলো-বাতাস চলাচল করে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন, কথা বলেন মীরা ভট্টাচার্যের সঙ্গেও।
আর সেই সৌজন্যের পথ ছিল দীর্ঘ। অসুস্থ বুদ্ধদেবের খোঁজ রেখেছিলেন 'প্রতিপক্ষ' মমতা। বৃহস্পতির দুপুরে দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠ ভারাক্রান্ত। তিনি পাম অ্যাভিনিউয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে যান। ভারী গলায় বলেন, 'বুদ্ধবাবু সুস্থ থাকা অবস্থায় যতদিন এসেছি অনেক গল্প করেছি। আজ সেই কথা বলব না।'
শোকাতুর মমতা কিছু স্মৃতিতে তালাচাবি দিয়ে রাখতে চাননি। প্রেক্ষাপট সিঙ্গুর আন্দোলন। রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর বাড়িতে ডাকা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বৈঠকের মাঝে হঠাৎ গোপালকৃষ্ণ গান্ধী প্রশ্ন ছিল দুই রাজনীতিকের দিকে, 'ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি... অন্তরাটা বল তো?' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'সেই সময় আমরা দুই জনেই ছিলাম। আমি বলেছিলাম যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা--নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা এই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে।' তিনি আরও বলেন, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় আমি মহাকরণে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, যদি কোনও কাজে আমি লাগি আমাকে জানাবেন…’।