• ‘করেছেন কী মশায়’, অদ্ভুত আন্তরিকতায় কথা বলতেন, অনেক সাংস্কৃতিক কর্মীর মতো আমিও তাঁর স্নেহ পেয়েছি : ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়
    আনন্দবাজার | ০৮ আগস্ট ২০২৪
  • ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়

    “করেছেন কী মশায়, সারা শহর জুড়ে তো দেখছি আপনারই পোস্টার”, ট্রেনের কামরায় বলেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

    আসলে সে বার আসানসোলে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি। তাই সেখানে অনেকগুলি পোস্টার পড়েছিল আমার অনুষ্ঠানের। ফেরার সময় ট্রেনে উঠব, দেখি খুব ভিড়, নিরাপত্তার কড়াকড়ি। মুখ্যমন্ত্রীও সেই সময় ছিলেন ওই শহরে, হয়তো কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল। উনিও ফিরবেন একই ট্রেনে। আমরা উঠব একই কামরায়। কিন্তু এমন নিরাপত্তারক্ষীর ভিড় যে, ট্রেনের দরজা পর্যন্তই পৌঁছতে পারছি না। উনি কী ভাবে যেন আমাকে দেখতে পেয়ে কর্মীদের বললেন, আমাকে একটু রাস্তা করে দিতে, যাতে ট্রেনটা ধরতে পারি। কামরায় উঠে কথা বলতে গেলে, উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, “করেছেন কী মশায়...”। খুব অদ্ভুত ভাবে বুদ্ধবাবু সকলকে ‘মশায়’ বলতেন।

    তবে সাহায্য কি শুধু এইটুকু! শিল্পীদের সঙ্গে ওঁর ছিল আন্তরিক যোগাযোগ। আমি কোনও দিনই রাজনীতির আশপাশে যাইনি। যেটুকু যোগ সবটাই আমার কবিতা আবৃত্তিকে কেন্দ্র করে। ২০০৫-০৬ সাল নাগাদ একটি আবৃত্তির রেকর্ডিং করেছিলাম। সেখানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি কবিতা বলেছিলাম, ‘একটি বাবা ও একটি মা’। কোনও সাংস্কৃতিক পত্রিকায় পড়েছিলাম কবিতাটি। আমার খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু কবিতা তো চাইলেই আবৃত্তি করে ফেলা যায় না বাণিজ্যিক ভাবে। ওঁর অনুমতির প্রয়োজন। তখনই প্রথম যোগাযোগ করি। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবের সঙ্গে কথা বলি। খুব খুশি হয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। সেই প্রথম দেখা ওঁর সঙ্গে।

    তারপর রবীন্দ্রসদনে একটি একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। সেই সময় সারা পশ্চিমবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি চলছে। তাই টিকিট বিক্রির টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করতে চেয়েছিলাম। সেই সময় আর একবার গিয়েছিলাম মহাকরণে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। উনি সময় দিয়েছিলেন। খুব আন্তরিক ভাবে কথা বলেছিলেন।

    তাঁর এক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান কম, এ কথা বলা যাবে না। সেই সময় যাঁরা সংস্কৃতি চর্চা করতেন, অনেকেই তাঁর স্নেহ পেয়েছেন। আমিও তাঁদের দলে রয়েছি। আজ দীর্ঘ রোগভোগের পর তিনি চলে গেলেন। খুবই মনে পড়ছে সেই সব দিনগুলির কথা। খুব সুন্দর ব্যবহার ছিল মানুষটির। রাজনৈতিক নেতা, মুখ্যমন্ত্রী, অসম্ভব শিক্ষিত একজন মানুষ, সেই সব কিছুর বাইরে তাঁর সুভদ্র ব্যবহারের কথাই সব থেকে বেশি মনে পড়ছে।

    যে ঘটনার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই আসানসোলের অনুষ্ঠান, একই ট্রেনে ফেরা— সেই দিনটির কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। বলা যায় বুদ্ধবাবুই আমাকে ট্রেনে ওঠার সুযোগ করে দিলেন। তার পর আমরা একই কামরায় ফিরেছিলাম। কিন্তু আসনের দূরত্ব অনেকখানি। মাঝপথে এক বার নিজে চা খেয়েছিলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার জন্যও পাঠিয়েছিলেন। আমি তখন সদ্য আবৃত্তি করছি, স্বাভাবিক ভাবে আপ্লুত হয়েছিলাম। এই স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ মানুষটিকে হয়তো চিরজীবী করে রাখবে। বৃহস্পতিবার চলে গেলেন বুদ্ধবাবু। এই সময় আমি শান্তিনিকেতনে রয়েছি, ফলে হয়তো শেষ বারের দেখাও সম্ভব হবে না। কিন্তু আমার শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি থাকবে চিরদিন।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)