বাংলার বিধানসভায়, আরও পরিষ্কার করে বললে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এক বার বিরোধী দলের এক সদস্য বক্তৃতা করতে উঠে বলেছিলেন, ‘‘ফ্রান্জ় কাফকার একটা গল্প আছে। নাম ‘মেটামরফসিস’। সেখানে একটি ছেলে সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করে যে সে একটা প্রকাণ্ড পোকা হয়ে গিয়েছে!’’ আরও কিছু বর্ণনা দেওয়ার পরে বক্তা বলেন, ‘‘আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান সেই মানুষটির মতো। তিনি ঘুমোতে গেলেন যখন, দিব্যি মানুষ। আর সকালে উঠলেন যখন, তখন প্রকাণ্ড এক পোকা! নড়াচড়া করতে কষ্ট। দরজার হাতল খুলতেও খুবই কষ্ট। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থা দেখে সেই পোকাটির কথা মনে পড়ে। যখন বিধানসভায় থাকেন, মনে হয় দায়িত্ব নিয়ে কথা বলছেন। আর যখনই আলিমুদ্দিনে গিয়ে পৌঁছন, সঙ্গে সঙ্গে পোকা! নড়তে-চড়তে ভারী কষ্ট।’’ বৃহস্পতিবার প্রয়াত হলেন তিনি।
বিরোধী বিধায়কের প্রশ্নের উত্তর দিতে উঠে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘আমি এই বক্তৃতা শুনে একটু অসুবিধায় পড়েছি। কারণ, এই গল্পটা আমি অনুবাদ করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু এ ভাবে এটাকে ব্যবহার করা হবে ভাবিনি।’’
‘পোকা’ গল্পের অনুবাদকের নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিধানসভায় সেই বিতর্কের সময় তিনিই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রিত্বের কথা মাথায় রেখে অবশ্যই কাফকার রচনা অনুবাদ করেননি বুদ্ধদেব। কিন্তু সেই মানুষটির মধ্যে পরবর্তী কালে একটা অস্থিরতা, মানসিক স্থৈর্যের অভাব দেখা গিয়েছিল। ‘মাথা ভেঙে দেব’ গোছের কিছু উক্তি তাঁকে রাজনীতিতে ঈষৎ অসংযমী করেছে। অন্য দিকে আবার জ্যোতি বসুর আমলে তিনি মন্ত্রিসভা ছেড়ে এসে সারা রাত ধরে কবিতার আশ্রয় নিয়েছিলেন ‘নন্দন’ প্রেক্ষাগৃহের একটি কোণে।
সেটা বিরোধীরা সম্যক বলতে পারবেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধবাবু ‘সফল’, এমন দাবি করতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বা একনিষ্ঠ সমর্থকেরাও দ্বিধা করবেন। কারণ, তাঁর আবেগ। একান্ত নিজস্ব আবেগ। সেই আবেগ তাঁকে বাম বা অবাম, কোনও পক্ষের কাছেই সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য করে তোলেনি। আসলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাই পর্ব তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলকে একান্ত ভাবে নির্ধারিত করেছে। ওই ঘটনা পর্বের প্রেক্ষিতেই তিনি নিজে বিধানসভা ভোটে হেরেছেন। একই সঙ্গে তাঁর দলও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।
এ তো গেল রাজনীতির বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা। যদিও এত সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে মূল্যায়ন একপেশে হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। কার্যত, মূল্যায়নটাই হয় কি না সন্দেহ। তবু প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে যে ছেলেটি সিপিএমের প্রাথমিক সদস্য হলেন, খাদ্য আন্দোলন থেকে ভিয়েতনাম, কোনও আন্দোলনই তাঁকে বাদ দিয়ে গড়ে ওঠেনি। সিপিআই ভেঙে তৈরি হওয়া নতুন দলটির ‘মিলিট্যান্সি’ও তাঁকে গভীর ভাবে আকর্ষণ করেছিল। তিনি ডিওয়াইএফের রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পরিবারের যে ছেলেটি শ্যামপুকুর স্ট্রিটের শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো করতেন, তিনি খুব কম সময়ের মধ্যে সিপিএমের রাজ্য নেতা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তার পিছনে কাকা সুকান্তের প্রভাব, স্কুল-কলেজের বৈশিষ্ট্য এবং কবিতা তথা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ একেবারেই কাজ করেনি, এটা ভাবা মুশকিল।
জ্যোতি বসুর ‘এলিটিজ়ম’-এর সঙ্গে তুলনা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বুদ্ধবাবুও সারা জীবন গরিব মানুষের কথা বলেছেন তাঁর ওই ‘এলিটিজ়ম’-এর টিকা হিসেবে। জ্যোতিবাবু বুদ্ধিমান, তিনি চেষ্টাও করেননি, সমালোচিতও হননি। বুদ্ধবাবুর বোধ অন্য রকম। তাই সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা আর নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরির জন্য ‘সরকার’ বাজি ধরতে চেয়েছিলেন। এবং সেই বাজিতে হেরেছিলেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। এই ক্ষেত্রে তাঁর বাজি ‘ব্যক্তিগত বুদ্ধদেব’। উত্তর কলকাতার বন্ধুরা বলেন, ‘বাচ্চু’। সেখানে তিনি জয়ী একান্ত ভাবে। দীর্ঘ দিনের জন্য তাঁর এই নিষ্ঠা তাঁকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরকারি দু’কামরার নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট। অত্যন্ত স্বল্প পরিসর। মন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী যে আমলেই হোক, তাঁদের পক্ষে অসুবিধাজনক বলেই বোধহয়। এ কথা সকলেই জানেন। সংবাদের শিরোনাম হওয়ার মতো খবর এটা নয়। তবু তাঁর এই কৃচ্ছ্রসাধন, এই ‘বনবাস’ তাঁকে যদি অহঙ্কার দিয়ে থাকে, তা হলে বোধ করি দোষ দেওয়া যাবে না।
তাঁর সাধের সাহিত্য, তাঁর স্কুল-কলেজের অহংবোধ, তাঁর রাজনীতিতে সাফল্য আর ব্যর্থতা দীর্ঘ সময় ধরে চর্চিত হবে কি না, বলা কঠিন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন যে প্রশংসার, তা নিয়ে রাজনীতির কোনও পর্বের কোনও মতদ্বৈধ নেই। থাকবেও না।