• সংস্কৃতি থেকে শিল্প, বুদ্ধ-সফরে বিপ্লব ও বিতর্ক...
    ২৪ ঘন্টা | ০৮ আগস্ট ২০২৪
  • জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের দ্বিতীয় এবং শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসান। বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম উত্তর কলকাতায়। ১ মার্চ, ১৯৪৪। পূর্বপুরুষের আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশ। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায় শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে পাশ করে তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র কিন্তু গোড়া থেকে ছাত্ররাজনীতির মূলস্রোতে ততটা সম্পৃক্ত ছিলেন না। কবাডি খেলতেন। খেলতেন ক্রিকেটও। চোখের সমস্যার জন্য তাঁকে ক্রিকেট খেলা ছাড়তে হয়। 

    বামপন্থী পরিবারে বেড়ে ওঠার সংস্কৃতি বুদ্ধদেবের উপর প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পর ১৯৬৪ সালে সিপিআই (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) ভেঙে সিপিএম বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) তৈরি হয়। এর দু’বছর পর ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব সিপিএমের সদস্য হন। ষাটের দশকের শেষের দিকে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফআই)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হন বুদ্ধদেব। খাদ্য আন্দোলনে অংশ নেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।

    বুদ্ধদেব সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন সত্তরের দশকের গোড়ায়। ১৯৭৭ সালে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচনে জেতেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন। এটি পরে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর নামে পরিচিত হয়। ১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হন বুদ্ধদেব। পরে ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে জিতে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন। সেই থেকেই তাঁর কেন্দ্র যাদবপুর। 

    নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন বুদ্ধদেব। শোনা যায়, তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি সচিবের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল তাঁর। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই সচিবের পক্ষ নেওয়ায় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব মন্ত্রিসভা ছেড়ে চলে এসেছিলেন। শোনা গিয়েছিল, তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘‘চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকব না।’’ কিন্তু তার কোনও সমর্থন কোনও তরফেই মেলেনি। বুদ্ধদেবের মন্ত্রিত্ব-ত্যাগ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল।

    ১৯৮৪ সাল থেকে বুদ্ধদেব সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য। ১৯৮৫ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে জ্যোতি বসুর সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন। পলিটব্যুরোর সদস্য হন ২০০০ সালে। সে বছরই ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেন জ্যোতিবাবু অবসর নেওয়ার পর। ২০১১ পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন।

    ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পালে হাওয়া’ ছিল বলে অনেকেই মনে করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। পরের বার, অর্থাৎ ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪-এর মধ্যে ২৩৫টি আসনে জেতে বামফ্রন্ট। ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বামফ্রন্টের শেষ মুখ্যমন্ত্রী। টানা ১১ বছরে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি। দায়িত্ব সামলেছেন স্বরাষ্ট্রদফতর, তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের । 

    ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে গুলি চালায় পুলিস। সংঘর্ষে নিহত হন ১৪ জন গ্রামবাসী। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই বিতর্ক তাড়া করতে শুরু করেছিল বুদ্ধদেবকে। বামফ্রন্টের রক্তক্ষরণ অব্যাহত ছিল। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য রাজনীতিতে বড় পটপরিবর্তন ঘটে। নন্দীগ্রামে গুলিচালনায় গ্রামবাসীদের মৃত্যুর ঘটনা বুদ্ধদেবের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন, ওই ঘটনার জন্য তিনিই ‘দায়ী’। ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে নন্দীগ্রামে পুলিসের গুলি চালানোর জন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন বুদ্ধদেব।

    বুদ্ধদেবের পেশ করা এক দলিলে ‘জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে’ এবং ‘সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে ব্যতিক্রম’ শীর্ষক দু’টি অধ্যায় ছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, ‘‘নতুন শিল্পের জন্য জমি প্রয়োজন। আমাদের রাজ্যে অকৃষি খালি জমি পাওয়া দুষ্কর। পরিকল্পনা করে এই জমিগুলি নির্দিষ্ট করতে হয়।’’ তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সরকারি পরিকল্পনা যতই বাস্তবসম্মত হোক, মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে পরিকাঠামো ও শিল্পের জমি ব্যবহারে দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে।’’

  • Link to this news (২৪ ঘন্টা)