অর্ণব আইচ: ‘বাবা, মাসতুতো ভাইয়ের পায়ে গুলি লেগেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’ কলকাতায় বসে ছেলের মুখে এই খবর শুনেই আঁতকে উঠেছিলেন মহম্মদ হজরত আলি ও তাঁর স্ত্রী বেলি বিবি। কিন্তু তখনও যে আতঙ্কের বাকি ছিল। ফের ঢাকা থেকে ছেলের ফোন। ‘বাবা, হাসপাতাল দেখে মনে হচ্ছে তোমার কাছে গল্প শোনা ১৯৭১ সাল। চারদিকে রক্ত। মেঝেতে রক্তের ছাপ। কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করছে। আবার কারও মাথা ফুঁড়ে দিয়েছে গুলি।’ ছেলের মুখে বিভীষিকাময় বর্ণনা শুনে পূর্ব কলকাতার মুকুন্দপুরে বসে ভয়ে কাঁপছেন ঢাকা জেলার আসুনিয়ার বাসিন্দা এই প্রৌঢ় দম্পতি। কলকাতায় চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন তাঁরা। কিন্তু এই অশান্তির মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায়ও দেখছেন না দম্পতি।
কেউ বা কলকাতায় রয়েছেন মাস দেড় বা দুয়েক ধরে। কেউ বা থাকছেন কয়েক সপ্তাহ ধরে। কেউ আবার সাময়িকভাবে ফ্ল্যাট বা ঘর ভাড়া নিয়েছেন। কেউ উঠেছেন হোটেলে। কিন্তু হাসপাতাল বা রাস্তাঘাটে যখনই দেখা হচ্ছে, তখনই আলাপচারিতায় সেদেশের হিংসা ও অশান্তি নিয়ে আশঙ্কাই প্রকাশ করছেন কলকাতায় চিকিৎসার জন্য আসা বাংলাদেশিরা। কিডনির অস্ত্রোপচারের পর ময়মনসিংয়ের জাকির আহমেদকে কয়েক মাস অন্তর কলকাতায় আসতে হয়। স্ত্রী, কন্যা ও ভাইকে নিয়ে জাকির এখন ভাড়া থাকছেন মুকুন্দপুরের একটি ফ্ল্যাটে। ময়মনসিংয়ে রয়েছে জাকিরের নাবালক ছেলে ও মা। তাঁদের জন্য চিন্তায় ঘুম ছুটেছে অসুস্থ জাকিরের। চাইছেন ওষুধ কেনার পরই বাংলাদেশে ফিরে যেতে। কিন্তু কীভাবে ফিরবেন জানেন না। বাড়ির লোকেদের শুধু বারবার বলছেন, সাবধানে থাকতে।
যদিও কীভাবে বাড়ি ফিরবেন, সেসবের তোয়াক্কা করেননি মহম্মদ সাকিব। পাবনার বাসিন্দা সাকিব পরিজনের চিকিৎসা করতে আসেন। প্রায় মাসখানেক ছিলেন কলকাতায়। কিন্তু বাংলাদেশের চারদিকে আগুন জ্বলছে, সেই খবর পেয়ে আর উদ্বেগ চেপে রাখতে পারেননি তিনি। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখতে পারছেন না সাকিব। আর তাতে আরও উদ্বেগ বেড়েছে তাঁরা। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে কোনওমতে পৌঁছেছেন গেদেয়। কিন্তু সীমান্ত পার হওয়ার পর তিনি পরিজনদের নিয়ে কীভাবে বাড়ি পৌঁছবেন জানেন না। কলকাতায় বসেই জেনেছেন, বাংলাদেশে যান চলাচলের অবস্থা ভালো নয়। ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির চালকরা যাতায়াত করছেন না। তাই শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনে ওঠার আগেও চোখেমুখে উদ্বেগ তাঁর।
এদিকে, অস্ত্রোপচারের কারণে গত ৬ মাস ধরে কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে রয়েছেন তহমিনা আখতার। সঙ্গে স্বামী ও ছেলে। এই অশান্তির মধ্যেও কোনওমতে বিমানে করে ঢাকা ফিরে যান তাঁরা। তহমিনার স্বামী ব্যবসায়ী। তাঁর সংস্থার কর্মীরা কাঁপছেন আতঙ্কে। রাজশাহীর বাসিন্দা বিউটি বিবি নিজেও অসুস্থ। একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তাঁর স্বামীরও। কিছুদিন আগেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশে। কিন্তু অশান্তির জেরে তা মুলতুবি রাখতে হয়েছে। কবে বাংলাদেশে ফিরবেন, তা নিয়ে ধন্দে এই বাংলাদেশিরাও।