প্রেসিডেন্সির ক্লাসরুম থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি, জানুন বুদ্ধদেবের উত্থান-পতন
এই সময় | ০৮ আগস্ট ২০২৪
ছিলেন না গতে বাঁধা বামপন্থী। আর তাই মুখ্যমন্ত্রী হয়েই সরকারি কর্মীদের দিয়েছিলেন ‘ডু ইট নাউ’-র পেপটক। মনে প্রাণে চেয়েছিলেন রাজ্য়ের শিল্পায়ন। কিন্তু, চোখের সামনে সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় তাঁর। শুধু তাই নয়, টানা ৩৪ বছরের বাম জমানার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই রয়ে গেলেন তিনি। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষটিকে হয়ত ‘পরাজিত সৈনিক’ হিসেবেই মনে রাখবে আগামীদিনের ইতিহাসবিদরা।তিনি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার, ৮ অগস্ট কলকাতায় প্যাম অ্য়াভিনিউয়ের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সম্পর্কে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর ভ্রাতুষ্পুত্র বুদ্ধদেবের জন্ম ১৯৪৪-র ১ মার্চ। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশে।
ছোটবেলায় শৈলেন্দ্র সরকার স্কুলের ছাত্র ছিলেন বুদ্ধদেব। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়) বাংলা সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হন তিনি। অনার্স-সহ বি.এ পাশ করেন বুদ্ধদেব। বামপন্থী পরিবারের ছেলে হওয়ায় ছাত্র জীবনেই বাম রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন প্রেসিডেন্সির এই প্রাক্তনী। যদিও প্রথম থেকেই রাজনীতির মূল স্রোতে ছিলেন না তিনি।
১৯৬২-তে চিনের সঙ্গে যুদ্ধের পর বদলে যায় ভারতের বাম রাজনীতি। ১৯৬৪-তে সিপিআই ভেঙে তৈরি হয় সিপিআইএম। এর ঠিক দু’বছরের মাথায় ১৯৬৬-তে নতুন দলটিতে (পড়ুন সিপিএম) যোগ দেন বুদ্ধদেব। আর বছর ঘুরতেই ১৯৬৭-তে পার্টির যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব চলে আসে তাঁর কাঁধে।
১৯৭৭-এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন জ্যোতি বসু। ওই বছর প্রথমবার কাশিপুর কেন্দ্র থেকে জিতে তথ্য় ও জনসংযোগ দফতরের মন্ত্রী হন বুদ্ধদেব। কিন্তু ৫ বছরের মাথায় ১৯৮২-তে কাশিপুর কেন্দ্রে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় তাঁকে।
১৯৮৭-তে কেন্দ্র বদল করে যাদবপুরে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বুদ্ধদেব। এবার কাঙ্খিত জয় পান তিনি। ফের জায়গা হয় জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায়। এবার তথ্য় ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হন প্রেসিডেন্সির এই প্রাক্তনী। উল্লেখ্য, ২০১১ পর্যন্ত টানা ২৪ বছর যাদবপুরই ছিল তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্র।
১৯৬৭-তে নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে হেরে হন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা প্রফুল্ল সেন। যার ৪৪ বছর পর একই ঘটনা ঘটে বুদ্ধদেবের সঙ্গেও। ২০১১-এ প্রবল পরিবর্তনের হাওয়ায় তৃণমূল প্রার্থী তথা প্রাক্তন আমলা মণীশ গুপ্তর কাছে ১৬ হাজার ৬৮৪ ভোটে পরাজিত হন বুদ্ধদেব। এর পর আর কখনই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি তিনি।
২০০০ সালের একেবারে শেষে পৌঁছে মুখ্য়মন্ত্রী পদ থেকে সরে যান জ্য়োতি বসু। ওই সময়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির বুদ্ধদেবকে রাজ্য চালানোর গুরু দায়িত্ব দেয় পার্টি। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী যখন কুর্সিতে বসেছেন, তখন আম-জনতার মধ্যে বামেদের বিরুদ্ধে জমতে শুরু করেছে ক্ষোভ।
যদিও পরের বছরের (২০০১) বিধানসভা নির্বাচনে সেই আঁচ দলের গায়ে লাগতে দেননি বুদ্ধদেব। তার উপর প্রবলভাবে ভরসা রেখেছিল বাংলার মানুষ। ফলস্বরূপ ২০০২-র ১৭ তম পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরোর সদস্য পদ পান তিনি। ২০০৬-এ সপ্তম বামফ্রণ্ট সরকার তৈরির অন্যতম মূল কারিগর ছিলেন তিনি। সেবার ২৯৪-র মধ্যে ২৩৫টি আসন জিতেছিল বামেরা। যাদবপুরে জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছিলেন বুদ্ধদেব।
এবার সরকারে বসে শিল্পায়নে জোর দেন সুকান্তর ভ্রাতুষ্পুত্র। রাজ্যে বিনিয়োগ করতে টাটা গোষ্ঠীকে রাজি করান তিনি। ঠিক হয়, সিঙ্গুরে এক লাখি গাড়ির কারখানা তৈরি করবেন টাটারা। কিন্তু জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে শুরু হয় গণ আন্দোলন। ফলে একটা সময়ে বাংলা থেকে ওই কারখানা গুজরাটে সরিয়ে নেয় টাটা গোষ্ঠী।
এর পর নন্দীগ্রামেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের বিরুদ্ধে জোর করে জমি অধিগ্রহণের অভিযোগ ওঠে। সেখানেও দানা বাঁধে আন্দোলন। সেখানে গুলি চালায় পুলিশ। ফলে প্রাণ হারান ১৪ জন গ্রামবাসী। সালটা ছিল ২০০৭-র ১৪ মার্চ।
নন্দীগ্রামের ঘটনার পর রাজ্যে শুরু হয় বামেদের রক্তক্ষরণ। ২০০৯-র লোকসভা ভোটে ৪২-র মধ্যে ২৭টি আসনে হেরে যায় বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বাম জোট। ২০১১-য় পুরোপুরি পতন হয় বাম সরকারের। ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর দলের অন্দরে একটি দলিল পেশ করেন বুদ্ধদেব। সেখানে অবশ্য রাজ্যের শিল্পায়ন নীতি ঠিক ছিল হলেই দাবি করেছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, রাজনীতি ছাড়াও ক্রিকেটকে দারুণ ভালোবাসতেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য়মন্ত্রী। ছোটবেলায় কিছুদিন খেলেও ছিলেন তিনি। তবে পরে চোখের সমস্যার কারণে সেখান থেকে সরে আসতে হয় তাঁকে। ক্রিকেটের জন্যেই প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তাঁর।