• বিলাসিতা বুদ্ধর কুষ্ঠিতে ছিল নাবিমান বসু
    বর্তমান | ০৯ আগস্ট ২০২৪
  • বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের শেষ পর্বে। ওর আর আমার মধ্যে অনেক কমন ফ্রেন্ড ছিল। সেই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন ভবতোষ সাহা। তিনি আমার খুব বন্ধু হয়ে যান। ভবতোষ আমাকে বললেন, ‘বুদ্ধ আপনাদের মনষ্ক।’ উনিই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বুদ্ধ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। বুদ্ধ দু’বছরই পড়ল, কিন্তু পরীক্ষা দিল না। অনেকে মিলে ওকে বলল, আমরা নোট তৈরি করে দেব। কিন্তু তাও পরীক্ষা দিল না। তার মানে হল, বুদ্ধ তখন থেকে অল্প অল্প করে পাড়ায় পার্টির কাজ শুরু করেছে। আমার মনে আছে, কলকাতার ৯ আর ১০ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করত। এখন অবশ্য সেই ওয়ার্ড বদলে গিয়েছে। বুদ্ধ সেই সময় শোভাবাজারে থাকত। ওদের সেই বাড়িতে আমি আর দীনেশ মজুমদার গিয়েছিলাম। একটা কথা খুব মনে পড়ছে, আমি তখন আত্মগোপনে ছিলাম। বুদ্ধর সঙ্গে একটা বাড়িতে বসে দীর্ঘ আলোচনা হল। আমি দেখলাম বুদ্ধ আমাদের রাজনীতির সঙ্গে একমত। আমি পার্টিকে বলি, ওকে সদস্য করা উচিত। 

    সেই ঘনিষ্ঠতা শুরু হল। প্রথম ডিওয়াইএফআইয়ের সম্মেলনে বুদ্ধ সম্পাদক নির্বাচিত হল। নিবিড়ভাবে সংগঠন শুরু করল। সেই সালটা ১৯৬৭-৬৮। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিন মন্ত্রিসভায় যাওয়ার সময় আমাকে বলল, ‘আপনি আজকে চলুন।’ আমি গেলাম। বললাম, ‘খালি হাতে যাবে?’ আমার কাছে কভার ফাইল ছিল। সেটা দিয়ে দিলাম। বুদ্ধ একটা সময় শোভাবাজার থেকে ট্যাংরায় যখন চলে আসে। আমাকে বলেছিল, ‘এখন আয় না করলে অসুবিধা।’ বাবার বইয়ের ব্যবসা বিক্রি করে দেয়। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বছর দুয়েক শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হয়। পাশাপাশি পার্টির কাজও করত। তখন প্রমোদ দাশগুপ্ত বুদ্ধকে ডেকে একদিন বললেন, ‘হোলটাইমার হতে হবে।’ সেটাই হল। ভালো বক্তা ছিল বলে বুদ্ধর  ডাক পড়ত জনসভায়। বিলাসিতা বুদ্ধর কুষ্ঠিতে ছিল না। জ্যোতি বসু ওকে অনেকবার বাড়িটা বদলাতে বলেছিলেন। গৌতম দেব একটা তিনটে ঘরের ফ্ল্যাটও দেখে দিয়েছিলেন। বুদ্ধ বলল, পাম অ্যাভিনিউতেই ভালো আছি। একবার চোখের সমস্যার জন্য হরকিষণ সিং সুরজিত্ হাভানায় পাঠিয়েছিলেন বুদ্ধকে। একটা গল্প আজ খুব মনে পড়ছে। একবার আমাদের আত্মগোপনে যেতে হবে। বুদ্ধ যেখানে যাবে বলে ঠিক করেছিল সেখানে অন্য কেউ চলে গিয়েছিল। বুদ্ধ আমাকে খবর দেয়। তখন আমরা দু’জনে একসঙ্গে থেকেছি। আমি আবার একা বিছানায় শুতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু সেবার বুদ্ধর সঙ্গে এক বিছানায় থেকেছি। বুদ্ধ সিগারেটের সঙ্গে ব্ল্যাক কফি খেত। বারবার বলতাম, ওটা খেলে ক্ষতি হয়। সে নিয়ে প্রায় ঝগড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল একাধিকবার। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছিল পার্টির জন্য। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু তা কখনও মনান্তরের চেহারা নেয়নি। আলোচনার মাধ্যমেই আমরা তা মিটিয়ে নিয়েছি বারবার। কার্যত বুদ্ধ ছিল আমার ছোট ভাইয়ের মতো। দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থ ছিল। সুভাষ (চক্রবর্তী), শ্যামল (চক্রবর্তী), অনিল (বিশ্বাস)-দের মতো শেষ পর্যন্ত বুদ্ধও যে আমায় ছেড়ে চলে যাবে তা ভাবিনি কখনও। তবে এটাই হয়তো ভবিতব্য ছিল।
  • Link to this news (বর্তমান)