• তাঁর ‘ডু ইট নাও’ বাংলায় ফিরিয়েছিল শিল্পের হাল
    এই সময় | ০৯ আগস্ট ২০২৪
  • কৌশিক প্রধান

    রাইটার্স থেকে বেরিয়ে হামেশাই নন্দন যাওয়া ছিল তাঁর দস্তুর। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি সপ্তাহে সাত দিনই বণিকসভার অনুষ্ঠানে যাওয়া অভ্যাস করে ফেলেছিলেন। নিজের এই রুটিন বদলাতে একটি আপ্তবাক্যও বেছে নিয়েছিলেন— ‘ডু ইট নাও।’বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বারে বারে বলা এই শব্দবন্ধটি বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের ‘স্থবির’ শিল্পায়ন ও ‘অচল’ কর্মসংস্কৃতিকে একটানে উপড়ে ফেলতে পারেনি। কিন্তু শিল্পের বিরুদ্ধে রাজ্যে জগদ্দল পাথরের মতো জাঁকিয়ে বসে থাকা মনোভাব ও সংস্কৃতিকে যে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই শিল্পক্ষেত্রে বাংলায় ৩৪ বছরের বাম-শাসনের মূল্যায়নের প্রশ্নে সবথেকে উজ্জ্বল অধ্যায় যে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাড়ে দশ বছরের সময়কাল, তা নিয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ থাকার কথা নয়।

    চিনের দেং জিয়াওপিং শিল্পে পুঁজি বিতর্কে একবার বলেছিলেন, ‘বেড়াল যতক্ষণ ইঁদুর ধরছে, ততক্ষণ বেড়ালের রং দেখা নিষ্প্রয়োজন।’ দেং-এর দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বুদ্ধদেব। তাই ভারতে কম্পিউটার চালুর বিরুদ্ধে একেবারে সামনের সারিতে থেকে আন্দোলন করা সিপিএমের কমরেড হয়েও বাস্তব আধুনিকতার প্রশ্নে কোনও ছুৎমার্গ ছিল না তাঁর। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে রাজ্যে উচ্চমানের মেধার প্রাচুর্যকে হাতিয়ার করে লগ্নি টানতে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়কালেই রাজ্যে পৃথক তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তর তৈরি হয়।

    আইবিএম থেকে টিসিএস। কগনিজ্যান্ট থেকে উইপ্রো। কলকাতায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্ববরেণ্য যে ব্র্যান্ডগুলি দপ্তর এখন রয়েছে, তার সবই আনার পিছনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আন্তরিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ অনস্বীকার্য। উইপ্রো-র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজি তাঁকে মুক্তকণ্ঠে ‘ভারতের সেরা মুখ্যমন্ত্রী’-র সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই রাজ্যের প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি নীতি, ২০০৩। যার ফলস্বরূপ পরবর্তী দু’বছরে বাংলার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়নের হার হয়েছিল ৭০ শতাংশের বেশি।

    সেই সময় ভারতের লগ্নি আকর্ষণ ও কর্মসংস্থানের নিরিখে ‘তথ্যপ্রযুক্তি রাজধানী’ হিসেবে খ্যাত বেঙ্গালুরুকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ দিতে শুরু করে কলকাতা। সল্টলেক সেক্টর ফাইভ-কে আন্তর্জাতিক দুনিয়া চিনতে শুরু করে তাঁর সময়েই। তৎকালীন ইনফোসিসের অন্যতম ডিরেক্টর টিভি মোহনদাস পাই মন্তব্য করেছিলেন, ‘উনবিংশ শতাব্দীর মতোই একবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণ কলকাতা থেকে শুরু হবে।’

    কলকাতা সম্পর্কে মোহনদাস পাইয়ের এই অগাধ আস্থা ও আত্মবিশ্বাসী মন্তব্যের আসল কারণ অবশ্যই ছিল শিল্পায়ন ও কর্মসংস্কৃতির বিষয়ে বুদ্ধদেবের অবস্থান। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর জনসমক্ষে স্বীকারোক্তি ছিল, ‘আমি এমন একটা দল করি, যারা ধর্মঘট করে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।’ তাঁর সাধের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে সিটুর জঙ্গি আন্দোলন থেকে বাঁচাতে ধর্মঘটের দিন যাতে সেক্টর ফাইভ সচল থাকে তা নিশ্চিত করতে তিনি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রকে প্রথম ‘পাবলিক ইউটিলিটি’ পরিষেবার স্বীকৃতি দেন।

    কিন্তু তাতেও আনা যাচ্ছিল না ইনফোসিসকে। আসলে তৎকালীন ইনফোসিস চেয়ারম্যান এন আর নারায়ণমূর্তি কিছুতেই বাংলার কর্মসংস্কৃতি নিয়ে নিঃসংশয় হতে পারছিলেন না। দীর্ঘ আট-ন’বছরের চেষ্টায় অবশেষে রাজি হয় ইনফোসিস। তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার দাবি মেনে নিউ টাউন রাজারহাটে ইনফোসিস-কে ৫০ একর জমি বরাদ্দ করার কথা ঘোষণা করল সরকার। ভারত তথা আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড ইনফোসিস রাজ্যে আসার ঘোষণা করার কয়েক মাস পরেই অবশ্য ভোটে হেরে বিদায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের।

    ভোটের অঙ্কে পরাজিত হলেও দেশ-বিদেশের শিল্পমহলের কাছে রাজ্য সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি অনেকটাই দূর করতে সমর্থ হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বু্দ্ধদেব ভট্টাচার্য, বক্তব্য বিশেষজ্ঞমহলের। শিল্পমহলের মতে, বিধানচন্দ্র রায়ের পরে রাজ্যে শিল্পায়নের জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো আন্তরিক উদ্যোগ আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে দেখা যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত প্রতি মাসে অন্তত চার-পাঁচ দিন কোনও না কোনও বণিকসভা আয়োজিত বা শিল্প সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাজিরা ছিল নিয়মিত। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ফের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পরবর্তী এক বছর তা বেড়ে মাসে গড়ে ১০-১৫ দিনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

    শিল্পায়নের প্রশ্নে বুদ্ধদেবের এই আন্তরিকতায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন রতন টাটা যে, তাঁর সাধের ন্যানো প্রকল্প গড়ার জন্য একাধিক রাজ্য সরকারের আকর্ষণীয় অফার থাকা সত্ত্বেও তিনি সিঙ্গুরকে বেছে নিয়েছিলেন। অন্য দিকে, শিল্পক্ষেত্রে বাংলাকে দেশের এক নম্বর গড়ার লক্ষ্যে দেং-এর দর্শন মেনেই দলের মধ্যে ও বাইরে প্রবল বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার একনায়ক শাসক সুহার্তো ঘনিষ্ঠ সালিম গোষ্ঠীর জন্য রাজ্যে লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিলেন।

    বিনিয়োগ টানার লক্ষ্যে ২০০৫ সালের অগস্টে সিঙ্গাপুর সফরে গিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে শার্ট-ট্রাউজ়ার্স পরতেও দু’বার ভাবেননি। আবার উল্টোদিকে পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি তিনি কোনও কারণে এতটাই অপ্রসন্ন ছিলেন যে, হলদিয়া পেট্রোকেমের ম্যানেজমেন্ট নিয়ন্ত্রণ তিনি রাজ্যের হাতেই রেখে দিয়েছিলেন।

    ন্যানো প্রকল্প ভেস্তে যায়। দিনের আলো দেখেনি সালিম গোষ্ঠীর প্রস্তাবিত কোনও প্রকল্পও। কিন্তু ১৯৯১ সালে কেন্দ্রের নয়া আর্থিক উদারনীতি ঘোষণার পর থেকে ২০০৮ পর্যন্ত শিল্পে লগ্নি পরিমাণের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ যে গোটা দেশে তিন নম্বরে উঠে আসে, তার সিংহভাগই এসেছিল বুদ্ধদেবের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়কালে। উদ্যোগ ও আন্তরিকতার কোনও অভাব ছিল না। কিন্তু যেটা তিনি বুঝতে ভুল করেছিলেন, তাঁর শিল্পায়নের স্বপ্ন আসলে বাম সরকারের ভূমি সংস্কারের সাফল্যে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর সেটাই হয়েছিল।

    কারণ ভূমি সংস্কারের জন্য পশ্চিমবঙ্গে মাথা পিছু জমির পরিমাণ এতই কম যে সিঙ্গুরে টাটাদের প্রকল্পের জন্য প্রায় ১০,০০০ পরিবারের থেকে ৯৯৭ একর জমি নিতে হয়েছিল। ফলে, বড় শিল্প যেখানে একলপ্তে অনেকটা বেশি জমির প্রয়োজন, তা রাজ্যের বুকে গড়ে ওঠা বাস্তবে হয়তো অসম্ভব নয়, কিন্তু, খুবই কঠিন। এই বাস্তবটা তিনি ধরতে পারেননি। তাই কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ-এর ডাক দিয়েও রাজ্যের জনমতকে তিনি সঙ্গে পাননি। কিন্তু, ভারতের শিল্প মানচিত্রে একেবারে পিছনের বেঞ্চ থেকে সামনের সারিতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে আনার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদান ও উল্লেখনীয় ভূমিকাকে ইতিহাসের পাতায় স্বীকার করতেই হবে।
  • Link to this news (এই সময়)