এই সময়: তখন সিঙ্গুর আন্দোলন চলছে। গাড়ি কারখানার জন্য সিঙ্গুরের গরিব চাষিদের জমি গায়ের জোরে দখল করে নেওয়া যাবে না- এই দাবিতে টানা আন্দোলন করছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ধর্না এবং তারপরে কলকাতায় ধর্মতলায় ২৬ দিনের অনশন আন্দোলন করেন মমতা। সমস্যা মেটাতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজভবনে বৈঠকে ডাকেন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী।বৃহস্পতিবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের দিন রাজভবনে সেই বৈঠকের কথাই মনে পড়ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, 'ওই বৈঠক চলাকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী 'ভরা থাক স্মৃতিসুধায়'- এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তরাটা জানতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধবাবুও বসেছিলেন আলোচনার টেবিলে। রাজ্যপালের কথার পরে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। তারপরে আমি অন্তরাটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, 'যে পথে যেতে হবে, সে পথে তুমি একা। নয়নে আঁধার রবে ধেয়ানে আলোকরেখা।'
মুখ্যমন্ত্রী জানান, বৃহস্পতিবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের খবরটা পাওয়ার পরে সে দিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল তাঁর। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে যে ভালো সম্পর্ক ছিল- সে কথাও জানান মমতা। তাঁর কথায়, 'ওনার সঙ্গে আমার অনেক বার কথা হয়েছে। উনি যখন সুস্থ ছিলেন, আসতাম, উনি অনেক গল্প করতেন। ব্যক্তিগত স্তরে অনেক কথা আছে। সেগুলো আজ বাইরে আনতে চাই না। কখনও সময় পেলে নিশ্চয়ই বলব।
বুদ্ধদেববাবুর প্রয়াণের খবর পেয়ে এ দিন সকালে তিনি ভীষণই টেনশ্ড হয়ে পড়েন বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, 'এতটাই টেনশ্ড হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমার হাতটা ঘষা খেয়ে যায়। গলগল করে রক্ত বেরিয়েছে অনেকটা।' তাঁর সংযোজন, 'বুদ্ধবাবুর শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে জানতাম। আগে যতবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আমি দেখতে গিয়েছি। উনি তখন সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন, সেটা আমাদের বড় প্রাপ্তি ছিল। আজ মীরা বৌদি'র (ভট্টাচার্য) কাছে জানতে পারলাম, এ দিন উনি ব্রেকফাস্টও করেছিলেন। তার পরেই ওনার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। ওনার মৃত্যুর বয়স হয়তো হয়নি, কিন্তু শ্বাসকষ্টের সমস্যায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন।'
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরিবার, তাঁর সন্তান সুচেতনকে সমবেদনা জানিয়েছি। সিপিএম, বামফ্রন্টের সবাইকেই সমবেদনা জানাই। একই সঙ্গে সহ-নাগরিকদেরও সমবেদনা জানাই।' মুখ্যমন্ত্রী পদে তাঁর পূর্বসূরির মৃত্যু যে রাজ্যের জন্য বড় ক্ষতি, তা-ও বলেন মমতা।
তাঁর কথায়, 'উনি দীর্ঘদিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, জনপ্রিতিনিধি ছিলেন, বিধানসভায় 'লিডার অব দ্য হাউস' ছিলেন, বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রিত্ব সামলেছেন। ওনার মৃত্যু রাজ্যের জন্য বড় ক্ষতি। ওনার অনেক অবদান রয়েছে। আজ তার বিশদ আলোচনায় আর যাচ্ছি না। তিনি পার্থিব জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু মানুষের মননে বিচরণ করবেন। একজন মানুষ মারা গেলেই তাঁর জীবন শেষ হয়ে যায় না। তাঁকে মানুষ মনে রাখে তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে। আসুন, আমরা প্রার্থনা করি, বারবার তিনি ফিরে আসুন এই বাংলার মাটিতে।'
ঝাড়গ্রামে একটি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির জন্য এ দিনই যাওয়ার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের খবর পেয়ে এ দিন দুপুরেই তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যান মমতা। কথা বলেন মীরা ভট্টাচার্য, সুচেতন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি জানান, রাষ্ট্রীয় সম্মানের সঙ্গে গান-স্যালুটের মাধ্যমে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে শেষ বিদায় জানাতে চায় রাজ্য সরকার। পাশাপাশি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণে রাজ্য সরকারের এ দিন সরকারি ছুটির কথাও ঘোষণা করেন মমতা।
ঝাড়গ্রামের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'আমি রবীন দেবকে (সিপিএম নেতা) বলেছি, ওনাদের পার্টির সঙ্গে কথা বলতে। তাঁরা চাইলে রবীন্দ্রসদন বা নন্দনে ওনার পার্থিব দেহ রাখা হবে। সেখানে অনেক মানুষ ওনাকে দেখতে পাবেন। বিধানসভাতেও নিয়ে যেতে বলেছি ওনার মরদেহ। বিধানসভার অধ্যক্ষও এই বিষয়ে অনুরোধ করেছেন। ওনাদের পার্টি যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেই ভাবে বাকি কাজ হবে।'
আজ, শুক্রবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ পিস ওয়ার্ল্ড থেকে নিয়ে যাওয়ার সময়ে যাতে কোনও সমস্যা না-হয়, সেজন্য কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ডিজিপি রাজীব কুমার, কলকাতার সিপি বিনীত গোয়েলদের প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, 'ফিরহাদ হাকিম ও অরূপ বিশ্বাস সারাক্ষণ থাকবে। পুরো বিষয়টি দেখভাল করবে। যখন মিছিল করে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে, তখন ওরা দেখবে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়।'